চার ফসলি শস্যবিন্যাসে চাষাবাদ হচ্ছে দেশের প্রায় ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে
মতিনুজ্জামান মিটু : বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯০ হেক্টর। মোট ফসলি জমি প্রায় ১৭৬ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪১ হেক্টর, যা জনসংখ্যার তুলনায় কম। আর তাই কৃষিতে শস্যনিবিড়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি নির্দিষ্ট জমিতে এক বছরে কয়টি ফসল উৎপাদন করা হয়, শস্যনিবিড়তা তাই নির্দেশ করে।
সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৃত্তিকার গুণাগুণ, সেচ সুবিধাসহ কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ততা, মালিকের অনুপস্থিতি, অতিরিক্ত জমির মালিকানা, বর্গা চাষ, অকৃষি খাতে উপার্জন বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানাবিধ কারণের ওপর জমির শস্যনিবিড়তার হ্রাসবৃদ্ধি নির্ভর করে। মৃত্তিকা পরীক্ষা করে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। দেশব্যাপী কৃষি অঞ্চলগুলোতে এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি শস্যবিন্যাস চলমান রয়েছে। ফসল উৎপাদন ও শস্যনিবিড়তা প্রসঙ্গে বিসিএস প্রশাসন একাডেমির সাবেক রেক্টর কৃষিবিদ সিকদার আনোয়ার বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানান, দেশে চার ফসলি শস্যবিন্যাস মোট ফসলি জমির মধ্যে প্রায় ৬১ হাজার ৮২২ হেক্টর চাষাবাদ হচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী ১৯৭১-৭২ সালে ফসলের নিবিড়তা ছিল ১৫৩.৭৪ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে বর্তমানে বেড়ে হয়েছে শতকরা ২০৫ ভাগ।
কৃষি অঞ্চল হিসেবে ফসল নিবিড়তা সবচেয়ে বেশি বগুড়া অঞ্চল ও যশোরে অঞ্চলে (২৩৬), সবচেয়ে কম স্বাভাবিকভাবেই রাঙ্গামাটি কৃষি অঞ্চলে (১৩৮)। এছাড়াও দেশের দক্ষিণাঞ্চল যেখানে নদ-নদী খাল-বিলের সংখ্যা বেশি সেসব (পটুয়াখালী ১৯৬, পিরোজপুর ১৬৫, খুলনা ১৭৬, ঝালকাঠি ১৮৩, সাতক্ষীরা ১৯৮, নোয়াখালী ১৭৩, বাগেরহাট ১৫৪, শরীয়তপুর ১৮৬ এবং বরিশাল ২০২) জেলায় শস্যনিবিড়তা অপেক্ষাকৃত জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। এক সময়কার প্রবাদ বাক্য ‘ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল’। সেই বৃহত্তর বরিশালে অনেক আবাদযোগ্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে না। অথচ ২০১৯ সালের কৃষি শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে কৃষি খানার সংখ্যা সর্বাধিক ৬৬শতাংশ। এখন বরিশাল নয় বরং উত্তরাঞ্চল বা পশ্চিমাঞ্চলকে বাংলাদেশের শস্যভান্ডার বলা হয় যেখানে চাষাবাদ হয় মূলত ভূগর্ভস্থ পানির সেচ দিয়ে।
একইভাবে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের জেলাগুলোতে বহু আগে থেকেই ভূমি মালিকদের অনুপস্থিত’র জন্য কৃষি জমিতে সঠিক মাত্রায় চাষাবাদ হচ্ছে না। অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত বা সাময়িকভাবে পতিত পড়ে থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে শস্যনিবিড়তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। সুনামগঞ্জ, সিলেট এবং মৌলভীবাজারে ২০১৩-১৪ সালে শস্যনিবিড়তা ছিল ১৩০, ১৫১ ও ১৫০। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৯-২০ সালে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারে শস্যনিবিড়তা কিছুটা বেড়ে ১৩৭, ১৭৬ এবং ১৮০ এ দাঁড়িয়েছে। এসব জেলাগুলোতে শস্যনিবিড়তা আরও বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিল্পের মতো উপকরণ, প্রযুক্তি বা বিনিয়োগ বাড়ালেই করলেই ক্রমাগত উৎপাদনশীলতা বাড়তে থাকেনা। একট পর্যায়ে গিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জমির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ খুব একটা নেই বরং শিল্পায়ন, নগরায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অকৃষি খাতে ভূমি ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর প্রায় এক শতাংশ হারে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। এটি কৃষির ওপর একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলা করতে হলে জমির পূর্ণ ব্যবহার করা দরকার।
সময় এসেছে সুচিন্তিতভাবে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলকে বিভিন্ন ফসলের আওতায় ভাগ করে চাষাবাদের আওতায় এনে কাংখিত মাত্রায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর। যেহেতু ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল একে বাদ দিয়ে শুধু অন্য ফসলের উন্নয়ন কখনই সময়োপযোগী হবে না। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশে মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা। তাই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কৃষি বিজ্ঞানীরা ২০৩০ সালের মধ্যে ১৯ কোটি জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অঞ্চলভিত্তিক শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। অধিকাংশ চার ফসলি শস্যবিন্যাসগুলোতে দুইটি ধান থাকায় খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।
বাংলাদেশের কৃষির মৌসুম ৩টি। রবি মৌসুম, খরিফ-১ ও খরিফ-২ মৌসুম। দেশব্যাপী ১৪ টি কৃষি অঞ্চল রয়েছে। সাধারণত অঞ্চলের কৃষি পরিবেশ (প্রাকৃতিকরূপ, ভূমিরূপ, সেচ ও দুর্যোগ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা এ যাবত অঞ্চলভিত্তিক চার ফসলি প্রায় ৭৪টি শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করা হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি কম ব্যবহার হয় সেক্ষেত্রে তিন মৌসুমে চার ফসলের শস্যবিন্যাস মসুর-মুগ রোপা আউশ- রোপা আমন হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া এ ধরনের শস্যবিন্যাসে মুগডালের পড বা ফল তুলে গাছগুলো মাটির সাতে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে এবং আমন ধানে কম ইউরিয়া সারের দরকার হয়। তবে মুগডালের গাছ মাটির সঙ্গে মিশানোর ৪ থেকে ৫ দিন পর আমন ধানের চারা লাগালে বেশি লাভ হয়। আর মুগডাল চাষে পানির তেমন প্রয়োজন হয়না। উৎপাদনে সময় ও খরচ কম হয়।
দেশব্যাপী ১৪টি কৃষি অঞ্চলের মধ্যে রাঙ্গামাটি ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলে চার ফসলি শস্যবিন্যাসে চাষ চলমান রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামার প্রবণতায় সা¤প্রতিক বছরগুলোতে সরকারিভাবে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি সেচের ব্যবস্থা নিরুসাহিত করা হচ্ছে। ভূউপরিস্থ পানি সেচের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের প্রচেষ্টা জোরদার করার দরকার রয়েছে।
মানুষের খাদ্যের প্রাথমিক যোগানদাতা কৃষি। শিল্প বা অন্য কোন সেক্টর থেকে খাদ্যের জোগান পাওয়া গেলেও ওইসব সেক্টর কৃষির ওপর নির্ভর না করে মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করতে পারে না। তাই কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিকল্প নেই। কেউ জমির যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে জমির মালিকানা অপরিবর্তিত রেখে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাতে অনুপস্থিত ভূস্বামীদের জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হতে পারে এবং এতে সার্বিকভাবে শস্যনিবিড়তা বাড়বে। কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের পূর্বশর্ত হচ্ছে কৃষিকাজকে লাভজনক এবং আনন্দদায়ক করা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, চাষাবাদ পদ্ধতি আধুনিকীকরণ, নুতন জাত উদ্ভাবন, বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া এসবই আনন্দদানের অনুষঙ্গ।
তিনি জানান, বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনগণ তাদের আয়ের বেশির ভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সব নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা। জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব নাগরিকের জন্য খাদ্য জোগানে সরকার প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।