
বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে কমতে পারে উদ্ভিদের কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণের পরিমাণ, বাড়ে গ্রিন হাউজ গ্যাসের উৎপাদনও

মতিনুজ্জামান মিটু: এতে মারাও যেতে পারে উদ্ভিদ। বালাইনাশক ব্যবহারে বিভিন্ন গ্রিনহাউজ গ্যাসের উৎপাদন বেড়ে জলবায়ু পরিবর্তনসহ পৃথিবীর উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করে। প্রয়োগকরা বালাইনাশকের মধ্যে কীটনাশকের শতকরা ৯৮ ভাগ এবং আগাছানাশকের ৯৫ ভাগই বাতাসে, পানিতে ও মাটিতে মিশে যায়। এছাড়াও ফসলে ও মাটিতে পড়ে থাকা বালাইনাশক পানি ও বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জলাশয়ে গিয়ে জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও জলজ প্রাণীকে ধ্বংস করে। কৃষি বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের মতে, বালাইনাশক ব্যবহারে সামগ্রীক পরিবেশই দূষিত হয় এবং মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বালাইনাশক ব্যবহারের গুরুত্ব ও ব্যবহারের সচেতনতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডাল গবেষণা কেন্দ্রের কীটতত্ত¡ বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলতাফ হোসেন জানান, কৃষি ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে যদি বালাইগুলোর বিরুদ্ধে কোন রকম প্রতিরোধ এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে ৭০শতাংশ পর্যন্ত ফলন নষ্ট হতে পারে। আগাছার কারণে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫শতাংশ, পোকামাকড়ের কারণে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং রোগবালাইয়ের কারণে গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন নষ্ট হতে পারে। বালাইনাশক ব্যবহারের প্রধান সুবিধা হচ্ছে ফসলের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় দমনের মাধ্যমে ফসলের ফলন ও গুণগতমান বাড়ে। মানুষ গাছপালা, মাছ ও প্রাণিসম্পদের রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণুর বাহককে (মশা, জাবপোকা, সাদামাছি, থ্রিপস ও অন্যান্য) দমন করে রোগের হাত থেকে কৃষিপণ্য ও জীবনকে সুরক্ষা করা যায়। এসব ব্যবস্থাপনার ফলে- কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ে, গুণাবলী উন্নত হয় এবং ক্ষতিকর সৃষ্টিকারী বিভিন্ন বালাই দমন হয়।
আমেরিকায় এক সমীক্ষামতে, বালাইনাশকের জন্য একগুণ টাকা খরচ করলে, বিনিময়ে চার গুণ টাকার উৎপাদন ফেরত পাওয়া যায় এবং বালাইনাশক ব্যবহার না করলে ফসলের গড়ে ১০ শতাংশ ফলন কমে যায়। বালাইনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হলে ফসলের উৎপাদন ও গুণগতমান কমে এবং দাম বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু মানুষ চাকরি হারাবে, পৃথিবীতে ক্ষুধার্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে, এমনকি দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। বালাইনাশক ব্যবহার এবং কৃষিপণ্য উৎপাদন একে অপরের সঙ্গে জড়িত। কাংখিত কৃষি উৎপাদনের জন্য বালাইনাশক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যথেচ্ছ বালাইনাশক ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে এবিজ্ঞানী জানান, সাধারণত বালাইনাশক হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ-যার উপাদান হচ্ছে অক্সিজেন, ক্লোরিন, সালফার, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, ব্রোমিন এবং সেসঙ্গে ভারী ধাতু যেমন- আর্সেনিক, কপার, সালফেট, সীসা, পারদ ইত্যাদি। বালাইনাশক মাত্রই বিষাক্ত, এরা বালাইকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করে মেরে ফেলে এবং বিভিন্নভাবেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যখনই বালাইনাশক কৃষি জমি, বাগান বা যেখানেই প্রয়োগ করা হোক না কেন সেটা প্রাকৃতিক সম্পদের সংস্পর্শে আসে।
বালাইনাশক কৃষি জমিতে ব্যবহারে দীর্ঘসময় পরিবেশে থাকে এবং সেগুলোর মাইক্রো ফোঁটাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং বাতাসের গুণমানের অবনতি ঘটিয়ে বাতাসকে দূষিত করে এবং ওই এলাকার জনসাধারণের শ্বাসের মাধ্যমে গিয়ে মানুষকে অসুস্থ করে। বড় ফোঁটাগুলো প্রয়োগকরা ফসলে এবং মাটিতে পড়ে। এখন ফসলে পড়ে থাকা বালাইনাশক ফসলের ক্ষতিকর ও উপকারী উভয় ধরনের জীবকেই ধ্বংস করে এবং ফসলের মাধ্যমে শোষিত হয়। শোষিত বালাইনাশক ফসলের দানায় ও ফলের মধ্যে অবশেষ হিসেবে থেকে যায়, ফলশ্রæতিতে মৌমাছিসহ অন্যান্য পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গ যারা ফুল ও ফল থেকে মধু নেয় ও পরাগায়ন ঘটায় তারাও মারা যেতে পারে। মাটিতে পড়ে থাকা বালাইনাশক মাটিকে দূষিত করে এবং মাটিতে বসবাসকারী নন-টারগেট জীব যেমন- উপকারী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, কেঁচো ইত্যাদিকে মেরে ফেলে। এসব উপকারী জীব মাটির জৈব পদার্থকে ভাঙতে সহায়তা করে এবং পানি ও পুষ্টি শোষণ করে সেগুলোকে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী করে, যা উদ্ভিদ শোষণ করে বাড়ে। যথেচ্ছা বালাইনাশক ব্যবহার করার কারণে অনিচ্ছাকৃত পরিণতি হিসেবে মাটির ওইসব উপকারী অনুজীব ধ্বংস হয় এবং পুষ্টি সরবরাহ বিঘিœত হয়ে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যের উপর স্বল্পমেয়াদি ক্ষতির প্রভাব পড়ে, আবার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রভাবও পড়ে। যা ঘটতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর লাগে। স্বল্পমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে-চোখ জ্বালাপোড়া করা, চামড়ায় জ্বালাপোড়া, ফুসকুড়ি ও ফোসকা পড়া ইত্যাদি। আবার, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রæত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়ায় বালাইনাশকের অবশেষ দীর্ঘসময়ে শরীরে জমা হয়ে জৈববিবর্ধনের কারণে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হ্রাস, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস বন্ধ্যাত্ব, জন্মগত ত্রুটি, ভ্রƒণের মৃত্যু, টিউমার, রক্ত ও ¯œায়ুবিক রোগ, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার নষ্ট হওয়া, অন্ত:¯্রাবী গ্রন্থির ঐক্যনাশ ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হয়- যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
বালাইনাশকের পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বিজ্ঞানী ড. মো. আলতাফ হোসেন জানান, বালাইনাশক একদিকে যেমন দেশের খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণকে বালাইয়ের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করছে আবার অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও সৃষ্টি করছে। এপ্রেক্ষিতে বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল সুরক্ষার উদ্দেশ্য এমন হতে হবে যেন বালাইয়ের আক্রমণের কারণে ফসল বিনষ্টের মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকে এবং পরিবেশের প্রতি ক্ষতিকর প্রভাবও সর্বনিম্ন হয়।
বিগত দুই দশকে জৈব বালাইনাশকের উন্নয়নে দর্শনীয় অগ্রগতি হয়েছে এবং মাঠে প্রয়োগ কৌশলও হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ট্রান্সজেনিক ফসল শতাধিকগুণ বেড়েছে। ট্রান্সজেনিক ফসল উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে উন্নত উন্নয়নশীল দেশে বালাইনাশকের ব্যবহারও যথেষ্ট পরিমাণে কমে এসেছে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে জৈব বালাইনাশকভিত্তিক কৌশলকে কার্যকরী করে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো গেলে বালাইয়ের আক্রমণে ফসল বিনষ্টের পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসবে এবং টেকসই এগ্রো -ইকোসিস্টেম সুনিশ্চিত হবে।
