
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল চাষে সফল হয়েছে দেশের কৃষক

মতিনুজ্জামান মিটু: বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত লেবুজাতীয় ফলের দুই তৃতীয়াংশই মাল্টা এবং আমদানিকরা বিদেশি ফলের অন্যতম হচ্ছে মাল্টা ও ড্রাগন ফল। ফল দুটো আমদানিতে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। আমদানি ব্যয় বাড়লে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকটে আমদানি ব্যয় কমাতে বিশ্বের অনেক দেশ বেশ তৎপর।
জাতীয় দৈনিক ও কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি করতে হয় ৮ লাখ ২৪১ টন। মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা। মাল্টা খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশে বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চলে বিদেশি ফল। এ সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ কম থাকে। উৎপাদন বাড়লে পর্যায়ক্রমে এসব ফলের আমদানি নির্ভরতা কমবে বলে আশা করা যায়। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল উৎপাদন প্রসঙ্গে এবিজ্ঞানী জানান, দেশে ফলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কৃষির নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সরকারের বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বর্তমানে মৌসুমি ফলের উৎপাদন ১ কোটি ৩০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। দেশীয় ফলের পাশাপাশি আমদানিনির্ভর ফলও দেশে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মাল্টা, ড্রাগন ফল, কাজুবাদাম, কফি, বেরি, স্ট্রবেরি, রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, লংগান ও রকমেলন দেশজুড়ে কমবেশি চাষ হচ্ছে। এসব ফলই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল হিসাবে বিবেচিত। এসব ফলের মধ্যে সা¤প্রতিক সময়ে সবুজ মাল্টা (বারি মাল্টা-১) ও লাল রঙের ড্রাগন ফল ভোক্তাদের বেশ দৃষ্টি কেড়েছে। চাহিদাও বেশ, দামও বিদেশ থেকে আমদানিকরা ফলের চেয়ে কম। স্বাদ ও মিষ্টতা বিদেশি ফলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পাকা সবুজ মাল্টা অত্যন্ত সুস্বাদু, রসালো ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি ফল। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফলগুলোর মধ্যে মাল্টা অন্যতম। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের কাছে এটি সমান জনপ্রিয়। ড্রাগন ফলও পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ফল। এফলে যে রঙিন পিগমেন্টেশন থাকে তা দেহের পুষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসব বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফলের চাষাবাদ করে কৃষক সফল হয়েছে।
মাল্টা ও ড্রাগন ফল আমদানিনির্ভর বিদেশি ফল হিসাবে পরিচিত ছিল। কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ফল দুটো দেশেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ দুটো ফলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। বারি মাল্টা-১ ও বারি মাল্টা-২ এবং বারি ড্রাগন ফল-১ নামে নিয়মিত ফলনদানকারী জাতগুলো অবমুক্ত হয়েছে বেশ আগেই। এই সঙ্গে অন্যান্য বিদেশী ফলের জাত হিসাবে বারি স্ট্রবেরির তিনটি জাত, রাম্বুটান এর একটি, অ্যাভোকাডোর একটি জাত এবং লংগান এর দুটো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন বারি’র বিজ্ঞানীরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার চৌকস কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জমানের মতে, মাল্টা ও ড্রাগন ফল গাছের এক একটি ফল যেন এক একটি ডলার। মনে হয় গাছেই বৈদেশিক মুদ্রা ঝুলছে। কৃষকের চাহিদার আলোকে তাদের প্রচেষ্টায় ফটিকছড়িতে অনেক মাল্টা ও ড্রাগন ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। কৃষকেরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন।
দেশে সবচেয়ে বেশি মাল্টা উৎপাদন হয় মাগুরা জেলায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মাল্টা উৎপাদনে দ্বিতীয় শীর্ষ রাজশাহী জেলা। এখানে ৬৭৭ টন মাল্টা উৎপাদন হয়েছিল। এরপর ছিল টাঙ্গাইল (৪৫৬ টন), রাঙামাটি (৪০৮ টন), বান্দরবান (৩৩১ টন) ও যশোর (৩০২ টন), দিনাজপুরে ২৮৩ টন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৫৮ টন, খাগড়াছড়িতে ২৬৬ টন এবং পিরোজপুরে ২০৮ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে মাল্টার উৎপাদন (ফসল-উত্তর ক্ষতি বাদে) ১০ হাজার টন ছাড়িয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্যে উঠে আসে। প্রতি কেজি মাল্টার গড় দাম ৮০ টাকা হিসাবে ফলটির বাজার ৮০ কোটি টাকা। যা বর্তমান ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০.০৯ টাকা ধরে হিসাব করলে এ পরিমাণ মাল্টা আমদানি করতে ডলার খরচ পড়বে ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ১৬১ ডলার!
উল্লেখ্য, এই সাইট্রাস জাতটি মাঠ পর্যায়ে গ্রহণের আগে বাংলাদেশ ২০০০ কোটি টাকা (২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সাইট্রাস ফল আমদানি করেছিল, কিন্তু এখন এটির আমদানি ব্যয় ১৫০০ কোটি টাকা কমেছে অর্থাৎ প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকা (৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সাশ্রয় হয়েছে। এটি একটি একক সাইট্রাস ফলের জন্য আশ্চর্যজনক সাফল্য। একইভাবে দেশে গত ছয় বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩১ গুণ। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে ঝিনাইদহ জেলায়। মোট ১৫১ হেক্টর জমিতে জেলাটিতে ৩ হাজার ৩৫৩ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে, যা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৩৯ শতাংশ। এছাড়া যশোর জেলায় উৎপাদন হয়েছে ৫১ হেক্টর জমিতে ৯৬৫ টন। নাটোর জেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে ৬৪০ টন, চট্টগ্রাম জেলায় ৫৫ হেক্টর জমিতে ৪১৮ টন ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১৭ হেক্টর জমিতে ৩৯৫ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে ৩৪৮ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ৮ হাজার ৬৫৯ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের গড় দাম ২৮০ টাকা হিসাবে ফলটির বাজার ২৪২ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। যা বর্তমান ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০.০৯ টাকা ধরে হিসাব করলে এপরিমাণ ড্রাগন ফল আমদানি করতে ডলার খরচ পড়বে ২ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার ৫৩৬ ডলার। এদিকে দেশে বিদেশি ফলের উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে হলে মৌসুমে আমদানিকরা ফলের ওপর শুল্ক আরোপ করার কথাও বলেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
