প্রচলিত পদ্ধতিতে গাছ কাটার কারণে বাড়ছেনা পুষ্টিসমৃদ্ধ খেজুরের রস
মতিনুজ্জামান মিটু: বেশি রস আহরণের জন্য প্রচলিত পদ্ধতি’র চেয়ে আধুনিকভাবে কাটা দরকার। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ গাছী দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে কাটলে খেজুরের রস ও গাছের স্থায়িত্ব দু’ই বাড়ে। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) এর মহাপরিচালক ড. মো. আমজাদ হোসেন জানান, স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত মানের খেজুরের গুড় বা সিরাপ উৎপাদনের জন্য রস সংগ্রহ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের সুস্থ গাছ নির্বাচন করা উচিত। সুস্থ সবল গাছ নির্বাচন করলে বেশি রস আহরণ করা সম্ভব। পাশাপাশি গাছী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ রস সংগ্রহ গাছীর দক্ষতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। খেজুরের রস সংগ্রহ গাছ কাটার ওপর নির্ভর করে।
খেজুর রস সংগ্রহের জন্য কিভাবে গাছ কাটতে হবে? গাছের কোন অংশে কতটুকু কোন সময়ে কাটতে হবে? বেশি পরিমাণ রস এবং সর্বোপরি গাছটি কিভাবে বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় সে ধারণা থাকতে হবে। এসব ধারণা বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান না থাকলে গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এমনকি গাছ মারাও যায়। ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারী ও মার্চ মাসে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি অর্থাৎ কার্তিক মাসের প্রথম দিকে গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়। গবেষণায়মতে, গাছের বেড়ের ১ বা ৩ অংশ লম্বা ও ৭.৫ সেন্টিমিটার চওড়া করে গাছ কাটলে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায় এবং গাছের কোন ক্ষতিও হয় না।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি (কার্তিক মাসের প্রথম দিকে) গাছ পরিষ্কার এর কাজ শুরু করা দরকার। গাছ পরিষ্কার করার পর পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন গাছ ছাঁটতে হয়, যাতে গাছ থেকে রস নি:সরণ শুরু হয়। কোন কোন গাছ ছাঁটা শুরুর ৩ থেকে ৪ দিনের মধেই রস নি:সরণ শুরু হয়। এরপর ছাঁটা অংশের যেখানে রস নি:সরণ শুরু হয় সেখানে একটি ইউ আকৃতির চিকন প্রায় ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি বাঁশের কাঠির আধা ইঞ্চি পরিমাণ গাছে ঢুকিয়ে দিতে হয়। ইউ আকৃতির কাঠির মধ্য দিয়ে রস ফোঁটায় ফোঁটায় গাছের ঝুলন্ত হাঁড়িতে জমতে থাকে। তবে গাছ একবার ছেঁটে ৩ থেকে ৪ দিন রস সংগ্রহ করা উচিত এবং পরবর্তী ২ থেকে ৩ দিন গাছ শুকাতে দিতে হয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে গাছ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
প্রাপ্ত বয়স্ক একটি গাছে দৈনিক ১০ থেকে ২০ লিটার রস নভেম্বর মাস হতে মধ্য মার্চ মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। রস সংগ্রহের পর মাটির হাঁড়ি প্রতিবার ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে হয় বা আগুনে সেঁকে নিতে হবে। এতে রস নষ্ট হবে না। অনেক সময় কাঠবিড়ালী, বুলবুলি, কাক, কাঠঠোকরা ইত্যাদি পাখি খেজুরের হাঁড়িতে বা রসের নলে বসে রস খায়। এসব পশু পাখির মাধ্যমে যেন কোন রোগ জীবাণু না ছড়ায় বা রস দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য খেজুরের গাছে হাঁড়ি ঝুলানোর সময় রসের হাঁড়ির মুখে জাল বা নেট দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিতে হবে যাতে কাঠি থেকে হাঁড়িতে রস পড়তে কোন অসুবিধা না হয় বা নেটের সঙ্গে রস লেগে না যায়।
বিএসআরআই মহাপরিচালক ড. মো. আমজাদ হোসেন আরও জানান, খেজুরের গুড় বা পাটালি তৈরি করতে খেজুরের রস বা সিরাপ ভালোভাবে ছেঁকে নিয়ে কড়াইয়ের মধ্যে রেখে জ্বাল দিতে হবে। ফুটন্ত ঘনীভূত রস হাতলের সাহায্যে লাগাতার নাড়তে হবে এবং চুলার তাপমাত্রা দ্রæত কমিয়ে আনতে হবে। চুলা থেকে গুড় নামানোর সময় মিশাতে চাইলে হাতলের সাহায্যে গুড় অর্থাৎ এক চিমটি পরিমাণ গুড় ২০০ মিলিলিটার পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। পানিতে গুড় দ্রæত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে এবং চুলা থেকে গুড়সহ কড়াই দ্রæত নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে এবং ছাঁচে ঢালতে হবে। পুষ্টিগুণ বিচারে খেজুরের রস থেকে তৈরীকরা গুড় উৎকৃষ্টমানের। এতে থাকা প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও আয়রনের পরিমাণ অনেক বেশি। খেজুরের গুড় সাদা চিনির একটি চমৎকার পরিপূরক। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ থাকে। এটা অনেক খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক বা কৃত্রিম উপাদান নেই। এছাড়া এতে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ঠান্ডা ও কাশি সারাতে সাহায্য করে।
পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নিরাপদ খেজুরের রস এবং গুড়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি জানান, খেজুরের গুড়ে উচ্চমাত্রার কম্পোজিট কার্বহাইড্রেট থাকে। যা স্বাভাবিক চিনির চেয়ে খাবারকে দ্রæত হজম করে। এতে উচ্চ মাত্রার ডায়েটারি ফাইবার থাকে যা কন্সটিপেসান, অনিয়মিত বাউয়েল মুভমেন্ট এবং অপরিপাকজনিত সমস্যা দূর করে। খেজুরের গুড় মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করে। প্রতিদিনের ডায়েটে এক টেবিল চামচ গুড় যোগ করলেই দ্রæত ফলাফল পাওয়া যায়। শুষ্ক কাশি, ঠান্ডা এবং এজমা সারাতে খেজুর গুড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা মিউকাস দূরীকরণের মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে।
খেজুরের গুড়ে উচ্চমাত্রার আয়রন থাকায় এটা হিমোগেøাবিন লেভেল বাড়ানোর মাধ্যমে অ্যানেমিয়া দূর করে। এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম নার্ভাস সিস্টেমকে পরিচালিত করে। এগুড় একইভাবে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং পটাশিয়ামও সমৃদ্ধ। খেজুরের গুড় ক্যালসিয়ামের একটি চমৎকার উৎস যা হাড়কে শক্তিশালী করে। এটি আর্থারাইটিস, জয়েন্টের ব্যথা এবং অন্যান্য হাড়জনিত সমস্যাগুলোও দূর করে। পটাশিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় এটা শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স নিয়ন্ত্রণ করে।