বিশ্বব্যাপি খাদ্য এবং দারিদ্রের কৌশলগত সংকট(১)
কলিন টড হান্টার
২০২২ সালের মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস (Antonio Guterres) ইউক্রেন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অনাহারের ভয়াবহতা এবং বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থার চরম বিপর্যয়’ সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন। গুতেরেস বলেছিলেন, সরবরাহ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং এর ফলে অতিদরিদ্র মানুষজন চরম বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থা আবার বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতার বীজ বপন করছে।আন্তর্জাতিক খাদ্য বিশেষজ্ঞদের (International Panel of Experts on Sustainable Food Systems)মতে, সারা বিশ্বে বর্তমানে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের ঘাটতিজনিত কোনো ঝুঁকি নেই। (উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ার ফলে তার বিতরণ-সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু যুদ্ধের ফলে বণ্টন ব্যবস্থার সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে সংকট তৈরি হচ্ছে)।আমরা আমাদের চারপাশে খাদ্যের যথেষ্ট প্রাচুর্য দেখতে পাই, কিন্তু দাম ঊর্ধ্বমুখী। সমস্যাটি খাদ্য ঘাটতিজনিত নয়; বরং খাদ্যপণ্য নিয়ে ফাটকাবাজিজনিত। মানুষের চাহিদা ও প্রকৃত খাদ্য নিরাপত্তার বিপরীতে একটি অন্তর্নিহিত ত্রæটিযুক্ত খাদ্যব্যবস্থাকে কর্পোরেট কৃষি ব্যবসায়ী এবং পণ্য সরবরাহকারীদের স্বার্থে ব্যবহারের কারণে বিশ্বব্যাপী এ সমস্যা (সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাওয়া) দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ হলো একটি ভূরাজনৈতিক বাণিজ্য ও জ্বালানি সম্পর্কিত দ্ব›দ্ব। এই যুদ্ধ রাশিয়া ও ইউরোপের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক (proxy) যুদ্ধ; রাশিয়া থেকে ইউরোপকে আলাদা করার একটি চেষ্টা। একদিকে ইউরোপকে বিপর্যস্ত করা এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর (ইউরোপের জনগণকে) পুনরায় আরও নির্ভরশীল করে তোলার জন্য রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাইকেল হাডসন (Michael Hudson) স¤প্রতি বলেছেন, শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ হলো ইউরোপ ও জার্মানির বিরুদ্ধে। (রাশিয়ার বিরুদ্ধে) নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হলো ইউরোপ ও অন্য মিত্রদের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা থেকে বিরত রাখা।১৯৮০ সাল থেকে উদারনৈতিক নীতিমালা মার্কিন অর্থনীতিকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে দিয়েছে। রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীল ভিত্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এর আধিপত্য বজায় রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় চীন ও রাশিয়ার (বিশেষত অর্থনীতির) ভিত্তিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং ইউরোপকে দুর্বল করা। হাডসন বলেন, বছরের শুরুতে বাইডেন এবং মার্কিন নয়া রক্ষণশীলরা নর্ডস্ট্রিম ২ এবং রাশিয়ার সঙ্গে সমস্ত (জ্বালানি) বাণিজ্য অবরুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিল, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ খাতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।বর্তমানে green agenda’-র নানা ধরনের বাগাড়ম্বর সত্তে¡ও অন্যান্য দেশের ওপর কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে আছে। এমনকি রাশিয়া ও চীন ডলার থেকে দূরে সরে গেলেও মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার প্রচেষ্টার যে মূল চাবিকাঠি–তেল ও গ্যাসের ডলারে মূল্য নির্ধারণ (এবং এর ফলে ঋণ) এবং নিয়ন্ত্রণসেটি রয়েই গেছে।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কার্যকরী হবে (এবং এর প্রভাব) যুক্তরাষ্ট্র তা আগেভাগেই জানত। তারা জানত, এই নিষেধাজ্ঞা বিশ্বকে দুটি বøকে বিভক্ত করার অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে এবং একটি নতুন শীতল যুদ্ধের ইন্ধন জোগাবে, যার একদিকে থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আর অন্যদিকে থাকবে প্রধানত দুটি দেশ-চীন ও রাশিয়া। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এও জানতেন যে, জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যের কারণে ইউরোপ ভয়ংকর দুর্বিপাকে পড়বে এবং ক্রমবর্ধমান দামের কারণে খাদ্য আমদানিকারক দক্ষিণ বিশ্বের মানুষ চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বড় ধরনের সংকট সৃষ্টির কৌশল এই প্রথমবারের মতো করেছে এমনটি নয়। (তারা বরাবরই) অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দামে (বৃদ্ধিজনিত) অসহনীয় তীব্র আঘাতের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে নির্ভরশীলতা এবং ঋণের ফাঁদে কার্যকরীভাবে আটকে ফেলতে চেষ্টা করে।Andrew Gavin Marshall ২০০৯ সালে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ১৯৭৩ সালে (তখনো ডলারের স্বর্ণভিত্তিক মানদÐ থেকে বেরিয়ে আসার খুব বেশিদিন হয়নি) হেনরি কিসিঞ্জার মধ্যপ্রাচ্যের (আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ‘জ্বালানি সংকট’) ঘটনাগুলো নিজেদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) স্বার্থে ব্যবহার করতে কীভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন। ভিয়েতনামে যুদ্ধের কারণে কার্যত দেউলিয়া হওয়া এবং জার্মানি ও জাপানের অর্থনৈতিক উত্থানের কারণে হুমকির সম্মুখীন হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের নেওয়া কৌশলগুলো বিশ্বব্যাপী অব্যাহত আধিপত্য বজায় রাখতে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।ভিয়েতনামে যুদ্ধের কারণে কার্যত দেউলিয়া হওয়া এবং জার্মানি ও জাপানের অর্থনৈতিক উত্থানের কারণে হুমকির সম্মুখীন হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের নেওয়া কৌশলগুলো বিশ্বব্যাপী অব্যাহত আধিপত্য বজায় রাখতে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। কিসিঞ্জার ওপেকভুক্ত (Oil producing & export countries-OPEC) দেশগুলোর তেলের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি নিরাপদ করতে এবং এভাবে উত্তর সাগরের (North Sea)তেল সম্পদের ওপর নিজেদের অতিরিক্ত সুবিধা আদায়কারী অ্যাংলো-আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত মুনাফা আদায়ে সাহায্য করেছিলেন। এ ছাড়াও তিনি সৌদিদের সঙ্গে পেট্রোডলার ব্যবস্থাকে সংযুক্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে আফ্রিকান দেশগুলোকে একই পথের পথিক হতে সহায়তা করেন, যারা আবার (তেলভিত্তিক) শিল্পায়নের পথে যাত্রা শুরু করে এবং অন্যদিকে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এই দেশগুলোই (মার্কিন বলয়ে) নির্ভরশীলতা এবং ঋণের পাকচক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে। এটি ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, উচ্চহারে দাম নির্ধারণের তেলনীতির লক্ষ্য ছিল ইউরোপ, জাপান এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের ক্ষতিসাধন করা। বর্তমানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা নিশ্চিত করার জন্য জেনে বুঝে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের দারিদ্র্য অবস্থাকে জিইয়ে রেখে আবারও বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছে রাষ্ট্রটি। এই নির্ভরশীলতা এবং ঋণগ্রস্ততা সৃষ্টির কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে।( লেখাটি অর্থনীতিবিদ আনু মুহম্মাদ সম্পাদিত সর্বজনকথা নামক সংকলন থেকে নেয়া)