চিনি প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর হওয়ায় বেসরকারি খাতের কব্জায়
মতিনুজ্জামান মিটু : বর্তমানে বহুল আলোচিত ভোগ্যপণ্য চিনি’র দামের উর্দ্ধগতি কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছেনা। বেশ কিছু দিন ধরে দেশের বাজারগুলোতে প্রতি কেজি চিনির খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকা। এপণ্যটির বাজার এখন পুরোটাই বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম জানান, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সুগার এন্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের আওতায় পরিচালিত চিনিকলগুলোতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০ হাজার টন চিনি। এটুকু সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে রেশন হিসেবে সরবরাহ করার কাজেই লেগে যায়। বাজারে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য হস্তক্ষেপ করার মতো চিনি সরকারের হাতে নেই। বাজারের উচ্চমূল্য অবদমনে সরকারের সরাসরি প্রভাব খুবই সামান্য। দেশে সরকারি চিনিকলগুলোর সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে ৬টি বন্ধ করে দেওয়া হয় গত নভেম্বরে। বাকি ৯টি চলছে ঢিমে তালে। চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার প্রধান কারণ ক্রমাগত লোকসান।
তিনি জানান, গত ৫ বছরে ৪০ বিলিয়ন টাকা লোকসান দিয়েছে সরকারি চিনিকলগুলো। এরপরেও এদের রয়েছে ৮০ বিলিয়ন টাকা ব্যাংক ঋণ। এগুলো লোকসানে থাকার কারণ হলো চিনির বেশি উৎপাদন খরচ। মিলভেদে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ পড়ে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কিন্তু তা বিক্রি করতে হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া প্রক্রিয়াকরণ লোকসান, অতিরিক্ত কর্মচারীর সংখ্যা, দুর্নীতি, ইক্ষু থেকে চিনি আহরণের নিম্নতম হার মিলগুলোর লোকসানে থাকার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে চিনি আহরণের গড় হার ৫ শতাংশের ওপরে। ভারতে এর পরিমাণ ১০ শতাংশের ওপরে। এদেশের কম চিনি আহরণের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেরীতে ইক্ষু ক্রাসিং, ভালও জাতের ইক্ষু আবাদ না করা এবং যথাযথভাবে জমিতে সার না দেওয়া। দেশের কৃষকরা ইক্ষু উৎপাদনে অনেকটাই নিরুৎসাহিত তাদের লাভ কমে যাওয়ায়। তাতে ইক্ষুর আবাদি এলাকায় দারুণ ভাটা পড়েছে। উৎপাদন ও ফলন কমছে। মাসের পর মাস কৃষকরা চিনিকল থেকে তাদের দেওয়া ইক্ষুর মূল্য বুঝে পাচ্ছেন না। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পাচ্ছেন না দরকারি উপকরণ সহায়তা। চিনিকলের শ্রমিকরা পাচ্ছেন না তাদের নিয়মিত বেতন। দেশের রাষ্ট্রীয় খাতের চিনিকলগুলো অনেক পুরনো। সরকারি ১৫টির মধ্যে ১২টি স্বাধীনতার আগে এবং ৩টি পরে প্রতিষ্ঠিত। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়নের (বিএমআরআই) অভাবে এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা নেমে এসেছে অনেক নিচেয়। সরকারি চিনিকলগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ টনের উপরে। সেক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিনির মোট উৎপাদন হয়েছিল ৩৭ হাজার টন। এবার তা আরও নেমে এসেছে ৩০ হাজার টনে। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ইক্ষুর আবাদি এলাকা ছিল ১.৮ লাখ হেক্টর। এখন তা ০.৭৪ লাখ হেক্টর। দেশে মোট চিনির চাহিদা কম বেশি প্রায় ২০ লাখ টন। তার মাত্র ১.৫ শতাংশ সরবরাহ করছে সরকারি চিনিকলগুলো। বাকি চিনির চাহিদা মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। ওই আমদানির পুরোটা বেসরকারি খাতের কব্জায়।
এঅবস্থায় সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়নো ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। সেজন্য বন্ধ চিনিকলগুলো দ্রæত চালু করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তাছাড়া চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিক্রয়াকরণ শিল্প হিসেবেও এসব কারখানা গড়ে তোলা এবং উৎপাদনে বহুমাত্রিকতা আনা দরকার।