বিশ্বব্যাপি খাদ্য এবং দারিদ্রের কৌশলগত সংকট(২)
কলিন টড হান্টার, ব্রিটেনের উন্নয়ন গবেষক
মার্কিন নীতির কারণে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য এবং অনাহারের জ্বালায় ভুগবে (এখনো যে দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে)। ভূরাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-সংঘাতের কারণে যে মানুষগুলো (যাদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফাইজার গংয়ের মায়াকান্নার অন্ত নেই এবং (মহামারিকালীন) যাদের প্রত্যেকের দুই বাহুতে তারা সুঁই ফোটাতে চেয়েছিল) মারাত্মক পর্যুদস্ত আর ভয়াবহ ক্ষতির শিকার।
সাধারণ ধারণার বিপরীতে, রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ফলাফলের হিসাব কষতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভুল করেনি। মাইকেল হাডসন দেখিয়েছেন, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর লাভের পাল্লা ভারী হচ্ছে এবং জ্বালানি রপ্তানিকারক হিসেবে মার্কিন অর্থনীতির বিনিময় ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে। অধিকন্তু রাশিয়াকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হলো রাশিয়ার রপ্তানি (সার উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত গম ও গ্যাস) হ্রাস করা এবং সে সুযোগে কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা। কৃষি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এদিক দিয়েও লাভবান হবে। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে চায়।মাইকেল হাডসন দেখিয়েছেন, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর লাভের পাল্লা ভারী হচ্ছে এবং জ্বালানি রপ্তানিকারক হিসেবে মার্কিন অর্থনীতির বিনিময় ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে। অধিকন্তু রাশিয়াকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হলো রাশিয়ার রপ্তানি (সার উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত গম ও গ্যাস) হ্রাস করা এবং সে সুযোগে কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা। কৃষি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এদিক দিয়েও লাভবান হবে।বর্তমান নীতিগুলো, বিশেষত দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য এবং ঋণসংকট তৈরি করার জন্য সুকৌশলে সাজানো হয়েছে। তুলনায় বেশি তেল এবং খাদ্য আমদানির মূল্য পরিশোধের জন্য গৃহীত ঋণের বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ঋণসংকটকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় (জনগণের) সম্পদ বিক্রি এবং ব্যক্তিমালিকানার হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রাখতে (অতীতের ন্যায়) বিভিন্ন দেশের সরকারকে বাধ্য করতে পারে।
‘কোভিড ত্রাণ’ নামক ঋণের ছত্রছায়ায় এই সাম্রাজ্যবাদী কৌশলটি এসেছে, যা মূলত একই ধরনের (সাম্রাজ্যবাদী) উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। আইএমএফ কোভিড-১৯ ঋণ-এর ওপর করা অক্সফাম-এর একটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালে ৩৩টি আফ্রিকান দেশকে মিতব্যয়ীতার নীতি (মূলত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ গুটিয়ে বাজারব্যবস্থাকে প্রাইভেট পুঁজির হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেওয়ার নীতি) অনুসরণ করতে উৎসাহিত (চাপ দেওয়া) করা হয়েছিল। যার ফলে, বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোকে ২০২২ সালের মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা দিয়ে অন্যথায় (যদি ঋণ পরিশোধে ব্যয় না হতো) তারা তাদের খাদ্য আমদানির খরচ মেটাতে পারত।
২০২১ সালে ৩৩টি আফ্রিকান দেশকে মিতব্যয়ীতার নীতি (মূলত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ গুটিয়ে বাজারব্যবস্থাকে প্রাইভেট পুঁজির হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেওয়ার নীতি) অনুসরণ করতে উৎসাহিত (চাপ দেওয়া) করা হয়েছিল। যার ফলে, বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোকে ২০২২ সালের মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা দিয়ে অন্যথায় (যদি ঋণ পরিশোধে ব্যয় না হতো) তারা তাদের খাদ্য আমদানির খরচ মেটাতে পারত। অক্সফাম ও ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনালের (Development Finance International) অনুসন্ধান অনুযায়ী, আফ্রিকান ইউনিয়নের ৫৫টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ৪৩টি রাষ্ট্রকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মোট ১৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরকারি খাতের ব্যয় (জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা খাতের গৃহীত পদক্ষেপগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত) কাটছাঁট করার উদ্যোগ নিতে হবে (বিশেষত ঋণের কারণে)।২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্ব অর্থনীতি থমকে যাওয়া (lockdown) পলক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ঋণের একটি অভূতপূর্ব প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। (নতুন ঋণের সঙ্গে আসে কঠোর শর্তাবলি) শর্তাবলির মানে হলো, জাতীয় সরকারগুলোকে পশ্চিমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ডলারভিত্তিক এই ঋণ মার্কিন ডলারকে শক্তিশালী করতে এবং বিভিন্ন দেশের ওপর মার্কিন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য (আধিপত্য) সাধনের শক্তি জোগাতে সহায়তা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য রাশিয়া এবং বিশেষ করে চীনা শিবির ও তার ‘Ôbelt road উদ্যোগের মধ্যে ঢুকে না গিয়ে বিশ্বের দক্ষিণের বেশির ভাগ অংশ যেন তার প্রভাব বলয়ে ঘুরপাক খায়, তা নিশ্চিত করাই এর (মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার) উদ্দেশ্য।
২০১৪ সালে মাইকেল হাডসন (Michael Hudson)বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৃষি এবং খাদ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশির ভাগ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য করতে সক্ষম হয়েছে। নিজেদের ফসলে নিজেদের ভরণপোষণের জন্য নয়; বরং অর্থকরী ফসলএবং রপ্তানিমুখী খাদ্যশস্য উৎপাদনের শর্তসাপেক্ষ বিশ্বব্যাংকের ভূরাজনৈতিক ঋণকৌশল (নির্ভরশীল) দেশগুলোকে খাদ্য ঘাটতির অঞ্চলে রূপান্তরিত করেছে। নিজেদের ফসলে নিজেদের ভরণপোষণের জন্য নয়; বরং অর্থকরী ফসল এবং রপ্তানিমুখী খাদ্যশস্য উৎপাদনের শর্তসাপেক্ষ বিশ্বব্যাংকের ভূরাজনৈতিক ঋণকৌশল (নির্ভরশীল) দেশগুলোকে খাদ্য ঘাটতির অঞ্চলে রূপান্তরিত করেছে। ( লেখাটি অর্থনীতিবিদ আনু মুহম্মাদ সম্পাদিত সর্বজনকথা নামক সংকলন থেকে নেয়া)