বিশ্বব্যাপি খাদ্য এবং দারিদ্রের কৌশলগত সংকট(সমাপ্ত)
কলিন টড হান্টার
ব্রিটেনের উন্নয়ন গবেষক
মার্কিন ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে তেল খাত এবং কৃষি ব্যবসাকে একসঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। কার্গি (Cargill), আর্চার ড্যানিয়েল মিডল্যান্ড (Archer Daniel Midland), বুঞ্জ ((Bunge) ) ও লুই ড্রেফাসের (Louis Dreyfus) মতো আন্তর্জাতিক কৃষি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ নামক প্রভাবশালী ধারণাটির প্রসার ঘটিয়েছেন। জন-জাতির খাদ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক সে ধারণার সমর্থন জুগিয়েছে। এর সঙ্গে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার কোনো সম্পর্ক নেই; বরং এই ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত যা কিছু, তা বিশ্ববাজার এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং যেসবের প্রক্রিয়া আবার নিয়ন্ত্রণ করছে বিশাল বিশাল সব কৃষি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো।
তেলের পাশাপাশি বহু দশক ধরে মার্কিন ভূরাজনৈতিক কৌশলের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো বিশ্বব্যাপী কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ। ধনী তেল ব্যবসায়ীদের স্বার্থ কায়েমের উদ্দেশ্যে সবুজ বিপ্লব রপ্তানি করা হয়েছিল। অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলো বৃহৎ কৃষি-পুঁজির রাসায়নিক উপাদান (সার-কীটনাশক) এবং তেলনির্ভর কৃষির মডেল গ্রহণ করে (কৃষক উদ্ভাবিত প্রাকৃতিক কৃষির পরিবর্তে) যার জন্য কৃষির প্রয়োজনীয় উপাদান ও সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ঋণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এটি জাতিগুলোকে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার একটি জটিল ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে। যে ব্যবস্থা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে রপ্তানিমুখী মনোচাষের ওপর নির্ভরশীল। এটি আবার সার্বভৌম মার্কিন ডলারভিত্তিক ঋণ পরিশোধ এবং বিশ্বব্যাংক/আইএমএফের ‘কাঠামোগত সমন্বয়’ কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি, বিশ্বের অনেক দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরিবর্তে খাদ্য ঘাটতি এলাকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে।এবং আমরা এটাও দেখছি যে, দেশগুলোকে কৃষিপণ্য উৎপাদনের গোপন ঘূর্ণিপাকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। একদিকে তেল এবং খাদ্য কেনার প্রয়োজনে বৈদেশিক মুদ্রা (মার্কিন ডলার) অর্জন, অন্যদিকে এটি আবার রপ্তানিমুখী অর্থকরী ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ঘেরাটোপ হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষিবিষয়ক চুক্তি Agreement on Agriculture (AoA)বশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা’র ছদ্মবেশে এ ধরনের করপোরেট নির্ভরতার জন্য প্রয়োজনীয় বাণিজ্যব্যবস্থা তৈরিতে সহায়তা করে।অনাহারের প্রক্রিয়া তৈরি, মুনাফা শোষণ অর্থাৎ পরিকল্পনামাফিক খাদ্যসংকট প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে Navdanya International-এর জুলাই ২০২২-এর একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন এবং বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি-পরিকল্পনার মাধ্যমে (আন্তর্জাতিক) মূলত বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো লাভবান হয়েছে এবং সবুজ বিপ্লবের বাস্তবায়ন সম্পর্কিত দায়ভারকে এড়ানোর চেষ্টা জারি রাখা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ইউএস লবি এবং বাণিজ্য আলোচনার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক কারগিল ইনভেস্টর সার্ভিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও গোল্ডম্যান স্যাক্সের নির্বাহী ড্যান আমস্টুটজ (Dan Amstutz), , যিনি ১৯৮৮ সালে রোনাল্ড রিগান কর্তৃক এঅঞঞ-এর উরুগুয়ে রাউন্ডের জন্য প্রধান আলোচক নিযুক্ত হন। যিনি মার্কিন কৃষি ব্যাবসার স্বার্থকে নয়া নীতির ভেতর অঙ্গীভূত করতে সাহায্য করেন এবং যে নীতিমালা আবার পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য ও শিল্প কৃষি স¤প্রসারণের পরবর্তী গতি-প্রকৃতি পরিচালনা করতে সহায়ক হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি বিষয়ক চুক্তি বা AoA বিশ্ববাজারের দাম এবং দামের ওঠানামার ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য কৃষকদের রক্ষাকবচগুলোকে (রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাপ্ত সুবিধাদির ফলে একধরনের রক্ষাকবচ) বাদ দিয়ে দিয়েছে। আবার একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহৎ কৃষি ব্যাবসার সুবিধার্থে তাদের কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাও বলবৎ রেখেছে।Navdanya লিখেছে: ‘রাষ্ট্রীয় শুল্ক নিরাপত্তা এবং ভর্তুকি অপসারণের ফলে ক্ষুদ্র কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে কৃষক এবং ভোক্তাদের মধ্যে আয়-ব্যয়ের একধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। একদিকে কৃষকরা যা উৎপাদন করেন, তার জন্য দাম পান কম, অন্যদিকে ভোক্তারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দাম প্রদান করেন। মাঝখানে লাভের (বাণিজ্যিক) বড় অংশটি কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত মধ্যস্বত্বভোগীরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেন।’‘খাদ্য নিরাপত্তা’র নামে বিশ্ববাজার প্রক্রিয়ায় সংযুক্তি এবং ক্ষমতাবান করপোরেটগুলোর স্বার্থে খাদ্য সার্বভৌমত্ব এবং খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার পুরো ব্যবস্থাটিকে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এসবের কার্যকারিতা বোঝার জন্য আমাদের ভারতের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ভারতে সা¤প্রতিককালে বাতিল হওয়া কৃষি খামার আইনের লক্ষ্য ছিল, বিশ্বের অন্যান্য দেশ যে ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, সে উপায়ে দেশটিকে নয়া উদারনীতির ‘ংযড়পশ ঃযবৎধঢ়ু’-র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা।
উদারীকরণ’ সম্পর্কিত আইনটির আংশিক লক্ষ্য ছিল মার্কিন কৃষি ব্যাবসার স্বার্থকে পরিপুষ্ট করা। ভারতের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য মজুত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমে নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদে ফেলা এবং পরবর্তী সময়ে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে অস্থির বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীদের কাছে ধরনা দিয়ে খাদ্যের জন্য দরকষাকষি করা। বছরব্যাপী ব্যাপক কৃষক বিক্ষোভের কারণেই কেবল ভারত সরকারকে এই পথ অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক ফটকাবাজির মাধ্যমেও বর্তমান সংকটকে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। ঘধাফধহুধ লাইটহাউস রিপোর্টস (খরমযঃযড়ঁংব জবঢ়ড়ৎঃং) এবং দ্য ওয়্যার (ঞযব ডরৎব)-এর একটি তদন্ত প্রতিবেদনের উল্লেখ করে দেখিয়েছে যে, কৃষিপণ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিনিয়োগ সংস্থা, ব্যাংক এবং হেজ ফান্ডগুলো কীভাবে ফাটকা বাজারের (ভবিষ্যতের মুনাফা বৃদ্ধির মহল সাজিয়ে) মাধ্যমে কৃষিপণ্যের ক্রমবর্ধমান খাদ্যের দাম থেকে লাভ হাতিয়ে নিচ্ছে। এই বাজার ব্যবস্থায় ভবিষ্যৎ দরের সঙ্গে প্রকৃত চাহিদা এবং জোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; বরং প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ কারবার চলে ফাটকা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে।
আর্চার ড্যানিয়েলস মিডল্যান্ড (অৎপযবৎ উধহরবষং গরফষধহফ), বুঞ্জ (ইঁহমব), কারগিল (ঈধৎমরষষ) ও লুই ড্রেফাস (খড়ঁরং উৎবুভঁং) এবং বø্যাক রক (ইষধপশ জড়পশ) ও ভ্যানগার্ডের (ঠধহমঁধৎফ) মতো বিনিয়োগকারীরা দিনের পর দিন ধরে বিশাল সব আর্থিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে কিছু ‘দরিদ্র’ দেশে রুটির (নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের) দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। (আনু মুহাম্মদ-এর ভাষ্যানুযায়ী, এসব দেশকে দরিদ্র দেশ না বলে বলা উচিত দরিদ্রের দেশ। সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্তে¡ও দেশের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা-কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এসব দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি)।
বর্তমানের খাদ্যসংকট থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক কৃষি ব্যবসায়ীরা উদ্ভট ধরনের ‘সমাধানের’ কথা বলছেন। আরও বেশি উৎপাদন করতে এবং আরও ভালো ফলন খোঁজার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি এমন, যেন সংকটের কারণ উৎপাদনের স্বল্পতা! তাদের এভাবে বলার অর্থ হলো, আরও বেশি রাসায়নিক উপাদান (সার, কীটনাশক), আরও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল এবং এ-জাতীয় প্রক্রিয়ার ফাঁদে ফেলে দিয়ে অধিকাংশ কৃষককে ঋণ ও নির্ভরতার মধ্যে আটকে ফেলার বন্দোবস্ত করা।
বর্তমানের খাদ্যসংকট থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক কৃষি ব্যবসায়ীরা উদ্ভট ধরনের ‘সমাধানের’ কথা বলছেন। আরও বেশি উৎপাদন করতে এবং আরও ভালো ফলন খোঁজার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি এমন, যেন সংকটের কারণ উৎপাদনের স্বল্পতা! তাদের এভাবে বলার অর্থ হলো, আরও বেশি রাসায়নিক উপাদান (সার, কীটনাশক), আরও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল এবং এ-জাতীয় প্রক্রিয়ার ফাঁদে ফেলে দিয়ে অধিকাংশ কৃষককে ঋণ ও নির্ভরতার মধ্যে আটকে ফেলার বন্দোবস্ত করা।
ঘুরেফিরে সেই একই ধরনের মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বলা হয়, সারা বিশ্ব তার নিজস্ব উৎপাদনের অভাবে অনাহারে ভুগবে এবং তার জন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ীদের তৈরি করা ব্যবস্থার কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির জাঁতাকলে পড়ে সাধারণ মানুষকে পিষ্ট হতে হচ্ছে।
এবং সেই একই পুরোনো গল্প: একটি সমস্যার সমাধানের কৌশলে নতুন প্রযুক্তিগুলোকে প্রতিস্থাপনের স্বার্থে চাপ তৈরি করা এবং সংকটের অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলো উপেক্ষা করে পরবর্তী সময়ে যথারীতি তাদের কর্মকাÐকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সংকটকে ব্যবহার করা।
কৃষিবিদ্যা, সংক্ষিপ্ত সরবরাহ লাইন, খাদ্য সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে বর্তমান পরিস্থিতির সম্ভাব্য সমাধানগুলোর বিস্তৃত বর্ণনা করে বছরব্যাপী ঘধাফধহুধ-এর বহু নিবন্ধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের জন্য যুক্তরাজ্যের মতো জায়গায় শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে সমর্থন সংগ্রহ করা হচ্ছে। রেল ইউনিয়ন নেতা মিক লিঞ্চ (গরপশ খুহপয) শ্রমিক শ্রেণির পারস্পরিক শ্রেণিগত সংহতি এবং সচেতনতার ভিত্তিতে বিলিয়নিয়ার শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহŸান জানিয়েছেন, যারা তাদের শ্রেণিস্বার্থ সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল।
যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করছি, যেখানে স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী নতুন বিশ্বব্যবস্থা সাধারণ মানুষের অধিকার, জীবিকা এবং জীবনযাত্রার মানগুলোর ওপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করছে তার বিরুদ্ধে সর্বজনের সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ-লড়াইয়ের মাধ্যমেই কেবল এর ওপর অর্থপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করা যেতে পারে।
বহুদিন ধরে ‘শ্রেণি’র বিষয়টি মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে অনুপস্থিত। একমাত্র ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ প্রশ্নটিকে সামনে হাজির করানো সম্ভব। যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করছি, যেখানে স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী নতুন বিশ্বব্যবস্থা সাধারণ মানুষের অধিকার, জীবিকা এবং জীবনযাত্রার মানগুলোর ওপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করছে তার বিরুদ্ধে সর্বজনের সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ-লড়াইয়ের মাধ্যমেই কেবল এর ওপর অর্থপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করা যেতে পারে।
( লেখাটি অর্থনীতিবিদ আনু মুহম্মাদ সম্পাদিত সর্বজনকথা নামক সংকলন থেকে নেয়া)