ব্রি উদ্ভাবিত বীজ বপনযন্ত্র ব্যবহারে ঘুচবে কৃষকের দুঃখ
মতিনুজ্জামান মিটু : ধান চাষাবাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে চারা রোপণ অন্যতম। হাতে বীজ ছিটানো শ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ কাজ। এছাড়া সমভাবে বীজ ছিটানোও যায় না। এ কাজকে সহজ ও দ্রæত করার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ট্রেতে কম সময়, স্বল্প শ্রম ও সমভাবে বীজ ছিটানোর জন্য বীজ বপনযন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন। যন্ত্রটি ব্যবহার করে কমিউনিটি বেইজ চারা তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও ব্রি’র ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন জানান, কৃষিতে শ্রমিকের স্বল্পতায় শ্রমঘন কাজগুলোতে যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণে বেশি শ্রমিকের দরকার হয়। যন্ত্রের সাহায্যে ধানের চারা রোপণের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। রোপণযন্ত্রে ব্যবহারের জন্য ম্যাট টাইপ পদ্ধতিতে চারা তৈরি করতে হয়। ম্যাট টাইপ চারা তৈরিতে সমভাবে বীজ ছিটানো অত্যাবশ্যক। সমভাবে বীজ না ছিটালে মিসিং হিলের পরিমাণ বেড়ে যায়। হাতে বীজ ছিটানো শ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ কাজ এবং সমভাবে বীজ ছিটানো যায় না। একাজকে সহজ ও দ্রæত করার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ‘যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের’ আওতায় ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা ট্রেতে কম সময়, স্বল্প শ্রম এবং সমভাবে বীজ ছিটানোর জন্য বীজ বপনযন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন। যন্ত্রটি ব্যবহারে সময়, খরচ ও শ্রম সাশ্রয় হয়। নিয়ন্ত্রিত ও সমানভাবে বীজ ছিটানো যায়।এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে কমিউনিটি বেইজ চারা তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করে।
সাশ্রয়ী এযন্ত্রের কারিগরি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ব্রি’র কর্মকর্তাদ্বয় জানান, স্থানীয় ওয়ার্কশপে স্থানীয় সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে খুব সহজে যন্ত্রটি তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি স্বল্প প্রশিক্ষণপাওয়া নারী বা পুরুষ চালাতে পারে। প্রতি ট্রেতে অংকুরিত বীজ ছিটাতে ১ (এক) সেকেন্ড সময় লাগে। যন্ত্রটি দিয়ে প্রতি ট্রেতে ৯৫ থেকে ১৬০ গ্রাম অংকুরিত বীজ বপন করা যায়। একজন শ্রমিক প্রতিদিন ১৪৪০০টি ট্রেতে বীজ বপন করতে পারে। যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বপনের পর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে উপরের স্তর (৬ মিলিমিটার) কভার করা যায়। বিভিন্ন জাতের ধানের জন্য বীজ বপনের হার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যন্ত্রের ওজন (৯ কেজি) কম হওয়ায় সহজেই হাতে বহন করা যায়। হপারের বীজ ধারণক্ষমতা ৯ কেজি হওয়ায় প্রতিবার ৬০ থেকে ৭৫টি ট্রে তৈরি করা যায়। যন্ত্রটির আনুমানিক বাজারমূল্য ১২,০০০ টাকা মাত্র।
যন্ত্রটি চালনার আগে সমতল জায়গায় সারিবদ্ধভাবে ২ সেন্টিমিটার পরিমাণ মাটি ভর্তি ট্রে স্থাপন করে দুই পাশে রেইল বসাতে হবে। বীজের আকারের ওপর নির্ভর করে বীজ বপনের হার ঠিক করতে হবে। সমন্বয়কারী ডায়াল ঘুরিয়ে ব্রাশ এর ওপেনিং সমন্বয় করে বীজ বপনের হার ঠিক করতে হবে। সমন্বয়কারী ডায়াল ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরালে বীজ বপনের হার বাড়বে এবং ঘড়ির কাটার দিকে ঘুরালে বীজ বপনের হার কমবে। ধানের জাত ও অংকুরোদগমের পের ভিত্তি করে কাংখিত বীজের হার পাওয়ার জন্য ২ বা ৩ বার ট্রায়াল দিতে হবে।
যন্ত্রটি চালানোর জন্য বীজ ধান দিয়ে ব্রি বীজ বপন যন্ত্রটির হপার ভর্তি করে রেইলের উপর স্থাপন করতে হবে। শাটার লিভারটি সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে ক্লাচ এনগেজ করে বীজ ধান বা মাটি পড়ার জন্য শাটারটি খুলতে হবে। চালনাকারী হাতলটি যন্ত্রের পেছনে নির্ধারিত হুকে সংযুক্ত করতে হবে। চালনাকারী হাতলে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে ধীর গতিতে (প্রতি ট্রের জন্য এক সেকেন্ড) হেঁটে খালি বা ফাঁকা ট্রে থেকে বীজ বিতরণ বা ছিটানো শুরু করতে হবে। বীজ ছিটানোর সময় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই গতিতে যন্ত্রটি চালনা করতে হবে। পরবর্তীতে শাটার বন্ধ করার জন্য শাটার লিভারটি পেছনের দিকে টান দিয়ে ক্লাচকে ডিজএনগেজ করতে হবে যেন বীজ ধান না পড়ে। আবার মাটি ভর্তি নতুন ট্রে স্থাপন করে একই পদ্ধতিতে বীজ ছিটানোর কাজ শেষ করতে হবে।
সমতল স্থানে ট্রে এবং রেইল স্থাপন করতে হবে। যন্ত্রটি সবসময় কোথাও না থেমে একই গতিতে চালনা করতে হবে। রেইলের উপর থেকে পানি, কাদা বা ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হবে। বীজের উপর মাটির পাতলা স্তর প্রয়োগের জন্য সবসময় শুকনো মাটি ব্যবহার করতে হবে। ক্লাচ্ এনগেজ্ড থাকা অবস্থায় যন্ত্রটি পেছনে টানা বা সরানো যাবে না। একদিনের বেশি অংকুরিত বীজ বা বীজের ভ্রƒণ বা শিকড় বেশি বড় হলে যন্ত্রটি ব্যবহার করা যাবে না।