মাছের উৎপাদন বাড়াতে সেবা দিচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল
মতিনুজ্জামান মিটু: মাছচাষিদের পাশে থেকে রোগবালাই নিরসন ও নিরাপদ মাছ উৎপাদনে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার প্রত্যয়ে ২০১৬ সালে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এহাসপাতালটি। এটি একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী জনকল্যাণমূলক সংগঠন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান মো. মাসুদ রানা জানান; বাংলাদেশের পুকুর, নদী, খাল, বিল, হাওর, বাঁওড়সহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাপকভাবে এমনকি বর্তমানে ঘরের ছাদে বা ঘেরা জায়গায় বায়োফ্লক, হাইডেনসিটি এবং আরএএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ মাছ চাষে বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ এবং কৃষির একটা বড় অংশ দখল করে আছে মৎস্য চাষ। মাছে-ভাতে বাঙালি, মাছ ছাড়া বাঙালির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়না। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ, এসেক্টরের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের কয়েক কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
মাছ চাষ অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হলেও অভিজ্ঞতার অভাব, রোগবালাই, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ও প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মাছচাষিদের অনেক সময় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যা মৎস্য সেক্টর তথা দেশের অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে। মাছচাষিদের পাশে থেকে মাছ চাষের আধুনিক কলাকৌশল সংক্রান্ত সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া, মাছের রোগবালাই নিরসনে সহযোগিতা করা, মাছের মড়ক দেখা দিলে মাছের মড়কের উৎকৃষ্ট কারণ খুঁজে বের করা এবং তার সমাধান দেওয়াসহ মৎস্য চাষ ও মৎস্য চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরণের তথ্য দিয়ে দেশের মাছচাষিদের সহযোগিতা করে কাংখিত উৎপাদন পেতে এবং ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য গত ছয় বছর ধরে হাসপাতালটি’র কার্যক্রম চলছে।
প্রান্তিক ও সর্বস্তরের মাছচাষিদের মাছ চাষ সম্পর্কিত কলাকৌশলের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দিয়ে দরিদ্রতা বিমোচনে ভূমিকা পালন করা, মাছের রোগ নিরাময়ে পূব প্রস্তুতি সম্পর্কে সর্বস্তরের মাছচাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মাছের রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাষিদের পুকুরে বা জলাশয়ে গিয়ে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া, প্রত্যেক উপজেলার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মাছ চাষীদের নিয়মিতভাবে পুকুরের বা জলাশয়ের পানি পরীক্ষা করে পরামর্শ দেওয়া, চাষিদের মাছ চাষে আগ্রহ টিকিয়ে রাখতে নিয়মিতভাবে চাষিদের সঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের টিম দিয়ে মতবিনিময় করা, মৎস্য সেক্টরে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে গ্রামীণ বেকার যুবকদের মাছ চাষ ও মাছের রোগ দমন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে চাষিদের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার তৈরি ও ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে দিক নির্দেশনাদেওয়া, বায়োফ্লক, হাইডেনসিটি, আরএএসসহ যাবতীয় আধুনিক মাছ চাষ বিষয়ে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সঠিকভাবে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিবহন বিষয়ে হ্যাচারি ও নার্সারি মালিকদের সহযোগিতা দেওয়া, বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে মাছের মড়ক দেখা দিলে মাছ চাষিদের পাশে থেকে সাহস দেওয়া এবং মাছের নমুনা সংগ্রহ করে মড়কের কারণ খুঁজে সমাধান করা, উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদ রক্ষার্থে জনসচেতনতা বাড়ানো, সামাজিক যোগাযোগ ও হটলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে চাষিদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া, দেশের সব জেলায় ইউনিয়নভিত্তিক আঞ্চলিক মৎস্য পরামর্শ ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মাঝে নিয়মিতভাবে সেবার মান নিশ্চিতকরণ, মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একযোগে কাজ করে দেশের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াাের লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় মাছের রোগ ও আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ক নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া, মাছের রোগ নির্ণয় ও নিরাময় সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা পরিচালনা করা, জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের মধ্যে কুইজ বা রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের ব্যাপক প্রচারণা করা, প্রথম সারির মৎস্য ঔষধ উৎপাদনকারী সংস্থা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় ক্ষুদ্র ও দুঃস্থ মাছ চাষিদের মাঝে মাছের পোনা বিতরণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মাছ চাষিদের মেধাবী সন্তানদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় উচ্চশিক্ষায় বৃত্তির ব্যবস্থা করা, মৎস্য হ্যাচারি মালিক, মাছ চাষি, মাছ বিক্রেতাদের মধ্যে বন্ধন স্থাপন করে চাষিদের বাজার দর জানা এবং ন্যায্যমূল্য পেতে সহযোগিতা করা, নিরাপদ মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে মাছ চাষিদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং এর সুফল ও কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করা, ভোক্তাদের কাছে গুণগত মানের মাছ পৌঁছানোর লক্ষ্যে চাষিদের মাছ আহরণোত্তর ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সরকারের দেওয়া যেকোন কর্মকান্ড বাস্তবায়নে সগৌরবে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের উল্লেখযোগ্য কাজ।
এছাড়াও বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল নামক অ্যাপ্লিকেশন সফট্ওয়ার তৈরীকরার মাধ্যমে চাষিদের মৎস্য সেবা সহজীকরণ করা, মৎস্য অধিদপ্তরের যেকোন কর্মকান্ড বাস্তবায়নে সহযোগিতা দেওয়া, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পিকেএসএফসহ মৎস্য সেক্টরের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে দেশের মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে অংশ নেওয়া।
দেশের পাঁচটি বিভাগে একার্যক্রম চলমান রয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে সার্ভিস বুথ ও প্রতিনিধি। পর্যায়ক্রমে পুরো বাংলাদেশে এই সেবা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। যেসব প্রতিনিধি প্রান্তিক লেভেলে সেবা দেবেন তারা বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্ট হিসেবে পদায়ন হবেন। আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টদেরকে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দিয়ে মৎস্য চাষ, মৎস্য রোগ ব্যবস্থাপনা, খাবার ব্যবস্থাপনা, পানি পরীক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে বিস্তর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টগণ চাষির সমস্যা ভালভাবে জেনে বুঝে পুকুর বা জলাশয় পরিদর্শন ও পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে পরামর্শ দেবেন এবং কি পরামর্শ দিয়েছেন তা তাৎক্ষণিক সংগঠনের চিকিৎসা সচিবকে অবগত করবেন। তাদের আয়ত্বের মধ্যে না থাকলে সমস্যার বিস্তারিত ছবি ও পানি পরীক্ষার রিপোর্টসহ সংগঠনের চিকিৎসা সচিবের কাছে দাখিল করবেন, পরবর্তীতে চিকিৎসা সচিব তার টিমের সঙ্গে পরামর্শ করে আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টকে পরামর্শ পাঠাবেন। যা তিনি চাষিকে দ্রæততার সঙ্গে লিখিত আকারে দেবেন। আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টরা সংগঠনের চিকিৎসা সচিবদের সঙ্গে নিজ নিজ এলাকার মাছ ও মাছের রোগসংক্রান্ত সমস্যাবলী সমাধানের জন্য সচেষ্ট থাকবেন।
বর্তমানে রাজশাহী বিভাগ (নাটোর, নওগা, বগুড়া, জয়পুরহাট), ঢাকা বিভাগ (গাজীপুর, মানিকগঞ্জ), ময়মনসিংহ বিভাগ (ময়মনসিংহ সদর, নেত্রকোনা, জামালপুর), রংপুর বিভাগ (রংপুর সদর, দিনাজপুর) এবং চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে হাসপাতালটির মোট ৬৮টি সার্ভিস বুথ চালু রয়েছে।