বিশ্বকাপের বৈভবের মাঝেও কাতারিদের আতঙ্ক ফুরিয়ে আসছে তেল
সোমনাথ বসু : ‘আর মাত্র চল্লিশ, মেরেকেটে ষাট বছর। তারপর?’ ভাবলেই ঘুম উড়ে যায় শাহনওয়াজ-তামিমদের। এই বৈভব, সেন্ট্রাল দোহায় এসি অফিস, আপাদমস্তক কাচে ঢাকা অট্টালিকার ৩৮ তলায় তিন বেডরুমের আরাম, দু’টি দামি গাড়ি—সবই যে সাময়িক। কেন? বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আরও কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থার গবেষণা তাঁদের হাড়েমজ্জায় বইয়ে দিয়েছে আতঙ্কের স্রোত। আইএমএফের রিপোর্ট বলছে, তেল দুনিয়ার রংবাজির শেষের শুরু আর কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে। ফুরিয়ে আসছে তাদের ভাÐার। বিশ্ব এগিয়ে চলেছে নতুন জ্বালানি আবিষ্কারের দিকে। মেরেকেটে আর ৬০ বছর। একটা প্রজন্ম… তারপর? এদেশে যে কৃষি নেই, শিল্প নেই। পরবর্তী প্রজন্ম কি পথে বসবে?
তারাশঙ্করের জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায় হতে চান না আদ্যন্ত কেজো শহরের কর্মীরা। চান না বেদুইন জীবনে ফিরে যেতেও। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যে বড্ড কঠিন! মরুভূমির ধূ ধূ বালি পেরিয়ে নিরুদ্দেশের উদ্দেশে সেই যাত্রা… নির্জলা, নির্বান্ধব। সফরমাঝে মরু ডাকাতের হানা… ক্লান্তি, মৃত্যু। সেই আতঙ্ক ফিরে আসছে। ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়েছিল যে বেদুইন দল, আজ কাতার তাদেরই। একশো বছর আগে পর্যন্ত তারা উটের লোম দিয়ে তৈরি পশমের পোশাক, পশু আর সমুদ্র থেকে তোলা মুক্তোর ব্যবসা করত। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাসের বর্ণনায় তারা ‘সমুদ্র অভিযাত্রী’। সমুদ্রনির্ভর সেই জীবনে শুধু মাছ নয়, মুক্তোর সন্ধানই ছিল প্রধান পেশা। উনবিংশ শতাব্দীতে কাতারের শেখ মহম্মদ বিন থানির একটি কথা তো প্রবাদেই পরিণত হয়েছিল‘আমরা সকলেই ক্রীতদাস। আমাদের প্রভু একটাই মুক্তো।’
টার্নিং পয়েন্ট ১৯৪০। দুখনে অঞ্চলে তেল আবিষ্কারের পর কাতারকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। দারিদ্র থেকে একলাফে তারা পৌঁছে যায় বৈভবের চূড়ায়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এখানে। এদেশের নাগরিকদের ৮০ শতাংশ তারাই। কেউ পাকিস্তানি, কেউ বাংলাদেশি, আবার কেউ আফগান। কিন্তু পেটের টানে, ভাগ্য ফেরাতে এসে আজ তাদের আত্মাও মিশে গিয়েছে এই বেদুইনের দেশের হাওয়ায় বাতাসে। আজ তারা এদেশের ‘আমির’। শাহনওয়াজ-তামিমদের এখন মাসিক গড় রোজগার ৫০ হাজার রিয়াল (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে এগারো লক্ষ)। আয়ের সঙ্গে তালমেল আছে ব্যয়েরও। আর সঙ্গী আতঙ্ক। তাই মাসে ৪ লক্ষের বেশি টাকা তাঁরা সঞ্চয় করেন। পারলে আরও বেশি। উপায় যে এটাই! অর্থ রেখে যেতে হবে। অনেক। তাহলেই কিছু করে খেতে পারবে পরের প্রজন্ম। মিউচুয়াল ফান্ড বা সোনা। এই হল সঞ্চয়ের মাধ্যম। তবে সোনা কেনার জন্য দুবাইয়ে যান তাঁরা। কারণ, দোহায় সোনা আসে সিঙ্গাপুর থেকে, যা গুণমানে দুবাইয়ের সোনার থেকে খারাপ।
শুক্রবার দুপুরে মসজিদে নমাজ পড়ে বেরনোর সময় রাওয়ালপিন্ডির শাহনওয়াজ বলছিলেন, ‘দেশের জমি বেচে চলে এসেছিলাম এখানে। এখন আমার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি রয়েছে। দু’টি অফিস। সবমিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জন কর্মী। প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা আমার দায়িত্ব। এখন রোজগার ভালোই। কিন্তু আমরা তো আর কাতারি শেখেদের মতো হতে পারব না! ওদের সবার ইউরোপে সম্পত্তি রয়েছে। তেল ফুরোলে কেউ আর এদেশে থাকবে না। আমাদের সেই সুযোগ নেই। হিসেব করতেই হবে…। পাকিস্তানে ফিরেই বা কী করব! আবার নতুন শুরু?’ বাংলাদেশের তামিম তো সাফ বললেন, ‘এখানে আমরা কেউ স্বাধীন ব্যবসা করতে পারি না। কাতারের কোনও নাগরিককে সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। তাহলেই বুঝছেন, সবাই কীভাবে আখের গোছায়! তাই আমিও সেভিংস করছি। মিউচুয়াল ফান্ড বুঝি না। তাই যা বাঁচে, তাই দিয়ে সোনা কিনি।’
এখানে বৈভবের মোড়কের নিত্য সঙ্গী অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক। ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি…’বেদুইনের মাথার ছাদ নেই, জল নেই, স্বপ্ন নেই। সভ্যতা ও প্রাচুর্যের স্পর্শ তখন শুধুই থাকবে ইতিহাসের হলুদ পাতায়। সেটাই চায় না কাতার।