ডিজরাপটিভ ইনোভেশন: ছোট উদ্যোগগুলি যেভাবে বাজার দখল করে
অর্জয়িতা রিয়া
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রফেসর ক্লেটন ক্রিস্টেন্সন ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন (আগের সিস্টেমকে ভেঙে দেয় যে উদ্ভাবন) কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। তবে তিনি মনে করেন কথাটির অর্থ বুঝতে অনেকেই ভুল করে আসছে।কোনো ঘটনা যেটা একটা ইন্ডাস্ট্রিকে নাড়িয়ে দেয় এবং ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলি পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয় সে ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে অনেকেই “ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন” কথাটি ব্যবহার করেন। তবে ক্রিস্টেনসেন তাদের সাথে একমত নন। তিনি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউকে বলেন, “এভাবে কথাটির ব্যবহার বেশি বড় হয়ে যায়।“আসলে ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন প্রক্রিয়া এর চেয়ে সূ² বিষয় বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।একটা কম রিসোর্সের ছোট কোম্পানি যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রæত সময়ে বাজার দখল করে প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানিকে চ্যালেঞ্জ করে, সেটাকে বলা হচ্ছে ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন।
এই প্রক্রিয়ার শুরুতে ছোট কোম্পানি বাজারের নিচের লেভেল থেকে ব্যবসা আরম্ভ করে। অথবা তারা এমন একটা নতুন বাজার বা ক্রেতাশ্রেণী তৈরি করে যাদের কাছ থেকে মুনাফা সব চেয়ে কম আসে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলি যেহেতু বেশি মুনাফার জন্য আগ্রহী, তাই তারা কম মুনাফার জন্য ছোট প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে না।
এরপর এই নতুন কোম্পানি আরো ভালো অফার দিয়ে এক সময় তাদের মুনাফা বাড়ায় এবং বাজার দখল করতে থাকে। তারপর দেখা যায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাস্টমাররা নতুন কোম্পানির অফারে ঝুঁকে পড়ে এবং বাজারে নতুন কোম্পানির শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। আর এভাবে ডিজরাপশন ঘটে।
এই পুরো প্রক্রিয়া বুঝতে পারা ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই জরুরি। এটা নতুন উদ্যোক্তাদের মনোবল বাড়ায় এবং ইন্ডাস্ট্রিতে ডিজরাপশন ঘটানোর সুযোগ বুঝতে সাহায্য করে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা যাতে ডিজরাপশন এড়াতে পারে সেক্ষেত্রেও তাদের সাহায্য করে।
দুই ধরনের ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন
ডিজরাপটিভ কৌশল বিষয়ক একটা অনলাইন কোর্সে ক্রিস্টেনসেন দুই ধরনের ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন এর কথা বলেন। “লো এন্ড” এবং “নিউ মার্কেট”।
.
# লো-এন্ড ডিজরাপশন
একটা কোম্পানি যখন লো-কস্ট বিজনেস মডেল (কম খরচে চালানো যায় এমন ব্যবসার মডেল) ব্যবহার করে বাজারে কোনো পণ্যের সাশ্রয়ী ভার্সন নিয়ে আসে এবং নতুন এক শ্রেণীর ক্রেতা তৈরি করে সেটাকে বলা হয় লো-এন্ড ডিজরাপশন।
কম আয়ের ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করলে মুনাফাও কম থাকে। তাই শীর্ষ কোম্পানিরা এই ক্রেতাদের প্রতি আগ্রহ দেখায় না। বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে এমন দিকেই তাদের মনোযোগ থাকে।
লো-এন্ড ডিজরাপশন এর একটা উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে ছোট মেডিকেল ক্লিনিক এর কথা। বড় মেডিকেলগুলিতে সাইনাস ইনফেকশন থেকে শুরু করে ওপেন-হার্ট সার্জারি পর্যন্ত সব ধরনের সেবাই পাওয়া যায়। তাদের থাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যারা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য দক্ষ। সাধারণত অসুখ বা ইনজুরি যত জটিল হয়ে থাকে, রোগীর জন্য খরচের বোঝা তত বেশি হয়।
এই কারণে অনেক মানুষ ছোটখাট সমস্যার জন্য কম খরচের রিটেইল বা ছোট মেডিকেল ক্লিনিক পছন্দ করে। বাড়ির কাছে হওয়ার সুবিধা এবং তাড়াতাড়ি সেবা পাওয়াও এর পেছনে জরুরি কারণ। এভাবে ছোট ক্লিনিকগুলি ডাক্তারের চেম্বার বা মেডিকেল সেন্টারের জায়গা দখল করে।
র্যান্ড কর্পোরেশন (জঅঘউ ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ) এর মতে, সাধারণ ক্লিনিকে যাওয়া ৯০ শতাংশ রোগী কেবল ১০ ধরনের সমস্যা নিয়ে যায়। এর মধ্যে আছে গলা ব্যথা, কানে ইনফেকশন এবং কংজাংটিভাইটিস এর মতো রোগ। কিন্ত ডাক্তারের কাছে এই ১০ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর পরিমাণ মাত্র ১৮ শতাংশ এবং হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১২ শতাংশ।
র্যান্ড এর গবেষণা থেকে আরো একটা বিষয় পাওয়া যায় যে, অনেক সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর সাধারণ ক্লিনিকে একই মানের সেবা পাওয়া যায়। ফলে ছোট ক্লিনিকগুলি লো-এন্ড এর এই বাজার নিয়ে নেয়।
ডাক্তারের চেম্বার এবং বড় মেডিকেল সেন্টারগুলি বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা দেয় যেটা সাধারণ ক্লিনিক দিতে পারে না। বড় মেডিকেল সেন্টারের মূলত লাভজনক সেবার পিছনেই মনোযোগ দেয়, তাই সাধারণ ক্লিনিকের বাজার দখল করতে তারা বেশি উৎসাহী হয় না।
কিন্ত এক সময় সাধারণ ক্লিনিকগুলি আরো বিশেষায়িত সেবা প্রদানের জন্য নিজেদের তৈরি করে ফেলে। তখন মেডিকেল সেন্টারগুলি দেখে তাদের রোগীরা ছোট ক্লিনিকে সেবা নিতে চলে যাচ্ছে। এক সময় বিশেষায়িত সেবা এবং লাভজনক বাজার দখল করার মাধ্যমে সাধারণ ক্লিনিক পুরো স্বাস্থ্য খাতেই একটা ডিজরাপশন তৈরি করে।
.
# নিউ-মার্কেট ডিজরাপশন
আরেক ধরনের ডিজরাপটিভ উদ্ভাবনকে বলা হচ্ছে নিউ-মার্কেট ডিজরাপশন। একটা কোম্পানি যখন বাজারের কোনো পণ্য বা সেবার সাশ্রয়ী নতুন ভার্সন নিয়ে আসে সেটাকে বলা হচ্ছে নিউ-মার্কেট ডিজরাপশন। সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়াও এই ডিজরাপশনের আরো একটি বিষয় হচ্ছে, এখানে এমন একটা ক্রেতাশ্রেণীর কথা চিন্তা করে পণ্য আনা হয় যাদের কথা আগে কেউ ভাবেনি। খরচ সাশ্রয়ী এবং সহজপ্রাপ্য পণ্য অফার করার মাধ্যমে এই নতুন কাস্টমার গ্রæপ তৈরি হয়।
এমন নিউ-মার্কেট ডিজরাপশন এর উদাহরণ হচ্ছে ট্রানজিস্টর রেডিও। ১৯২০ সাল থেকে রেডিও’র বাজার মূলত বড় এবং দামি স্টেরিও সাউন্ড সিস্টেম কোম্পানিদের দখলে ছিল। সাধারণত ধনী পরিবারগুলি তাদের ঘরে ব্যবহার করার জন্য দামি স্টেরিও সিস্টেম কিনতো। এই ভারি যন্ত্রগুলি এমন ভাবে তৈরি যেন বসার ঘরে রাখা যায়। আর এগুলির সাউন্ড কোয়ালিটি ছিল বেশ ভালো।
এক সময় এলো পোর্টেবল বা বহনযোগ্য ট্রানজিস্টর রেডিও। ১৯৫৪ সালে বাজারে আসা টেক্সান ইন্সট্রæমেন্টস এর তৈরি এই রেডিওগুলি ছিল সস্তা এবং ছোট আকারের। যদিও এর সাউন্ড কোয়ালিটি ভালো ছিল ন। বড় আকারের রেডিও কনসোল এবং হাই-ফিডেলিটি সিস্টেম ধনী ক্রেতাদের আকর্ষণ করেছিল যারা ঘরে বসে মিউজিক শুনতে পছন্দ করতো। অন্যদিকে সস্তা ট্রানজিস্টরের এমন ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় হয় যাদের রেডিও কেনার সামর্থ্য ছিল না। বিশেষ করে ছাত্র বা কাজের জন্য যাদের বাইরে বেশি সময় কাটাতে হয় তাদের জন্য।
বড় রেডিও কনসোলের মান অনেক ভালো ছিল। কিন্ত ট্রানজিস্টর রেডিও সুলভ এবং এটি ব্যবহারকারীকে স্বাধীনতা দিয়েছিল। তাই এই নতুন পণ্য রেডিও বাজারে একটা নতুন ক্রেতাশ্রেণী তৈরি করে।
বড় কোম্পানিগুলির এই নতুন ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করার বেশি আগ্রহ ছিল না। কারণ এখানে মুনাফা কম। তাই তারা প্রতিযোগিতায় না গিয়ে টেক্সাস ইন্সট্রæমেন্টকে এই বাজার ছেড়ে দেয়।
এর পরে সময়ের সাথে পোর্টেবল রেডিওর মান আরো ভালো হয়। বিশেষ করে সনি ওয়াকম্যান, এমপি থ্রি প্লেয়ার, অ্যাপল আইপড এবং স্মার্টফোন আসার পরে এই ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে ঘরে ব্যবহার করার দামি রেডিও কনসোল এর চাহিদাও কমে যেতে থাকে। এইভাবে টেক্সাস ইন্ট্রæমেন্ট কোম্পানি রেডিও বাজারের একদম নিচ থকে ডিজরাপশন শুরু করে, যা এক সময় বাজারের শীর্ষে থাকা কোম্পানিকে সরিয়ে দেয়।
.
# উদ্ভাবকের মতো চিন্তা করা
আপনি একজন সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা অথবা অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী যাই হন না কেন, আপনাকে লো-এন্ড এবং নিউ-মার্কেট দুই ধরনের ডিজরাপশনই বুঝতে হবে।
ক্রিস্টেনসেন এর ডিজরাপটিভ উদ্ভাবন এর তত্ত¡ কাজে লাগিয়ে আপনি পুরোনো ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারেন অথবা নতুন একটা বাজার তৈরি করতে পারেন। আর আপনি কীভাবে বাজারে ডিসরাপশন ঘটাবেন সেই কৌশল তৈরি করতেও এই তত্ত¡ আপনাকে সাহায্য করবে। লেখক : ফ্রিল্যান্সিং সাহিতিক