ভারতের ওপর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নির্ভরতা: সম্ভাব্য পরিণতি
মোশাহিদা সুলতানা
দুটি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বর্তমানে ত্রিপুরা ও বহরমপুর থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। কিন্তু চাহিদা কম থাকায় গত তিন বছরে বিদ্যুৎ আমদানি না করে ভারতকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সরকারি উদ্যোগে দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখলে এই ক্যাপাসিটি চার্জের অর্থ বেঁচে যেত। তাই এই আমদানি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আদানির ঝাড়খণ্ডের ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো নির্মাণাধীন। সংবাদপত্রের সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ৫৬.২ শতাংশ বেশি ও অন্যান্য কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি দাম নেবে। সম্প্রতি বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদন অনুসারে দেখা গেছে, ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা, যা দিয়ে ৩টি পদ্মা সেতু বানানো যায়। (টিবিএস নিউজ ২০২২)
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় কোম্পানির যেসব প্রকল্প নির্মাণাধীন তার মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রকল্প হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। সম্পন্ন হওয়ার আগেই ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের সময় প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার কথা অক্টোবর ২০২২ ও দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার কথা ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। এই পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় কোম্পানির দ্বিতীয় প্রকল্পটির বিনিয়োগকারী ভারতীয় ধনকুবের অমল আম্বানির রিলায়েন্স। ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক এই প্রকল্পটি সেপ্টেম্বরেই উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই এলএনজির অভাবে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে পারছে না, ঠিক সেই সময়ে এ ধরনের একটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাংলাদেশের সংকটের সময় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না। এমনকি ভবিষ্যতেও এ প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এবং এতে জনগণের অর্থে আরও একটি প্রকল্প অব্যবহৃত সক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের দায়ে দায়গ্রস্ত হতে পারে।
এই ছয়টি প্রকল্প চালু হলে আগামী ২-৩ বছরে ৪৮৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হবে। এতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
জ্বালানি খাতের চিত্রটিও প্রায় একই রকম। বর্তমানে ১৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের কাজ চলছে। এই পাইপলাইন দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ডিজেল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা তৈরি হবে। এভাবে আমদানির সুযোগ তৈরি হলে বাংলাদেশের তেল পরিশোধন শিল্পে নিজেদের সক্ষমতা তৈরির তাগিদ থাকবে না। এবং কখনো সংকট মুহূর্তে ভারত ডিজেল রপ্তানি করতে অস্বীকৃতি জানালে তখন বাংলাদেশের জনগণ ভুক্তভোগী হবে। কৌশলগত দিক থেকে জাতীয় স্বার্থে এ ধরনের নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আমরা দেখছি, রাশিয়া কীভাবে ইউক্রেন ও ইউরোপের গ্যাস সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এই দেশগুলোকে কোণঠাসা করেছে। ভারতও যে প্রয়োজনে বড় দেশ হিসেবে ছোট দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে না, তা নিশ্চিত হয়ে কেউ বলতে পারে না। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা নিয়ে ভারতের চরম উদাসীনতাই বলে দেয়, ভারত এই জ্বালানি নির্ভরতাকেও তার স্বার্থে ব্যবহার করতে উদ্যত হতে পারে।
এ ছাড়া পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানির পক্ষে যৌক্তিকতা হাজির করতে গিয়ে বাংলাদেশ যে ২-৩ ডলার সাশ্রয়ের কথা বলছে তা আসলে ভিত্তিহীন। কারণ, ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধন করলে সাশ্রয় হবে ১১ ডলার। সে ক্ষেত্রে পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল আমদানির প্রকল্প আসলে আর্থিক দিক বিবেচনায়ও যৌক্তিক নয়।
সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত থেকে এলএনজি আমদানির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। প্রথমত, এলএনজি এমনিতেই ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি কমিয়ে যখন দেশেই গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না, তখন বাংলাদেশের দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে আরও বিনিয়োগ করা দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সংকটের সময়ও বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে এমন একটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছে। এলএনজি অবকাঠামো এমনিতেই সক্ষমতা পুরো কাজে লাগাতে পারছে না। এ অবস্থায় ভারত থেকে আমদানির জন্য নতুন অবকাঠামো নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা গ্যাস উত্তোলনের বিনিয়োগকেই এক অর্থে সংকুচিত করবে।
ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি (ঙঘএঈ) ২০১৪ সালে অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়। কয়েকবার মেয়াদকাল শেষ হলেও অগভীর সমুদ্র ব্লকে গত ৮ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওএনজিসির নিজস্ব প্রযুক্তি না থাকলেও তারা বিভিন্ন দেশ থেকে পরামর্শক ও সাপ্লাইয়ার নিয়োগ করে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। বাংলাদেশ চাইলে নিজেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে পারত। এতে বাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা তৈরিরও সম্ভাবনা ছিল। ওএনজিসি যেখানে দীর্ঘদিনেও এ কাজে অগ্রগতি দেখাতে পারেনি, সেখানে ওএনজিসির মতো প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ নিজ দেশের সক্ষমতা তৈরির পথে অন্তরায়ও সৃষ্টি করেছে। এমনকি আর্থিক দিক থেকেও বাংলাদেশ ওএনজিসির কার্যক্রমের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে বা হবে এমনও নয়। কারণ, ২০১৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ওএনজিসির বাজেট দ্বিগুণ হয়েছে। ভবিষ্যতে এই খরচ বেড়ে কত দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশ এই গ্যাস উত্তোলন থেকে আদৌ কোনোভাবে উপকৃত হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
যদিও রূপপুর প্রকল্পে ডিজাইন, চুল্লিপাত্র ও মূল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে ভারতকে যুক্ত করা হয়েছে বলা হয়, কিন্তু আমরা দেখলাম রূপপুর প্রকল্পে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের প্যাকেজ-৬-এর রিভারক্রসিং (২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ) প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার পেছনে এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত যে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র নিতে হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, দরপত্রে প্রস্তাবিত দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক বেশি। এ নিয়ে জটিলতা তৈরি করেছে ভারত। অবশেষে দীর্ঘদিন এলওসির ঋণের অপেক্ষায় থেকে বাংলাদেশ প্রকল্পটি এলওসি থেকে বাদ দিতে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। (মুহিব ২০২২) ব্যবস্থাপনায় ভারতের অংশগ্রহণের এই উদাহরণ ভারতের স্বার্থকেই আবার সামনে নিয়ে আসে।
উপসংহার
গত ১০ বছরে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অথবা ভারতীয় কোম্পানির সরাসরি বিনিয়োগে যেসব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প শুরু হয়েছে, সেগুলোকে প্রায়ই ভারতীয় সহযোগিতায় নির্মিত প্রকল্প হিসেবে হাজির করা হয়। অথচ এই প্রকল্পগুলোতে ভারতের আংশিক বিনিয়োগ থাকলেও এর ঋণ পরিশোধের দায় কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ওপরই বর্তায়। কাজেই ভারত বাংলাদেশের কৌশলগত নির্ভরতার দিক থেকে এই প্রকল্পগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই প্রকল্পগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রবন্ধে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের ওপর যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, আপাতদৃষ্টিতে তা নিরীহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প মনে হলেও সেগুলো আসলে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কিছু উদাহরণ। কারণ, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে কোনো-না-কোনো-হয় সাশ্রয়ী অথবা বেশি পরিবেশবান্ধব-বিকল্প ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই বিকল্পগুলো গ্রহণ না করে ভারতকে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেছে জাতীয় সক্ষমতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, কখনো করেছে পরিবেশের ক্ষতি করে, কখনো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, এবং কখনো বিনা প্রশ্নে জাতীয় নিরাপত্তার কথা না ভেবে কৌশলগত ঝুঁকির বিনিময়ে।প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে কোনো-না-কোনো-হয় সাশ্রয়ী অথবা বেশি পরিবেশবান্ধব-বিকল্প ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই বিকল্পগুলো গ্রহণ না করে ভারতকে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেছে জাতীয় সক্ষমতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, কখনো করেছে পরিবেশের ক্ষতি করে, কখনো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, এবং কখনো বিনা প্রশ্নে জাতীয় নিরাপত্তার কথা না ভেবে কৌশলগত ঝুঁকির বিনিময়ে। ভারতের ওপর ভবিষ্যতে যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নির্ভরতা তৈরি হতে যাচ্ছে, কৌশলগত দিক বিবেচনায় তা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কারণে। আমরা এরই মধ্যে দেখছি, বৈশ্বিক সংকট মুহূর্তে যেকোনো দেশের আমদানি নির্ভরতা কীভাবে সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঋণ পরিশোধের দায়। আমরা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখেছি কীভাবে অপ্রয়োজনীয় খাতে বিদেশি বিনিয়োগ দেশের রিজার্ভকে তলানিতে পৌঁছে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত দিয়ে বেষ্টিত রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন ভারতের জন্য শুধু আর্থিক দিক বিবেচনায়ই নয়, কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও একটি উপায়। খুব অল্প সময়ে এই নির্ভরতা যদি ২০ শতাংশের ওপরে চলে যায় এবং বাংলাদেশ যদি তার নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের উত্তরোত্তর প্রভাব ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের আরও বেশি সুযোগ তৈরি করে দেবে।
মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: সড়ংযধযরফধ@ফঁ.ধপ.নফ