বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সম্মেলন (কপ-১৫) জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণে ঐতিহাসিক চুক্তি
এম. মোশাররফ হোসাইন, মন্ট্রিয়ল (কানাডা) থেকে ফিরে
কানাডার মন্ট্রিয়লে জাতিসংঘের বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে (কপ-১৫) প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান সুরক্ষায় বিশ্বের ১৯০ দেশের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসের বিপরীতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এই চুক্তিকে প্রকৃতি রক্ষার সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গত ৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনের শেষ দিনে অনেকটা নাটকীয়ভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অনেক দেন-দরবার আর দর-কষাকষির পর স্থানীয় সময় ১৯ ডিসেম্বর ভোররাতে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করা হয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ রক্ষায় সবপক্ষ সম্মত হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভ্যাটিকান সিটি ছাড়া বিশ্বের ১৯৬ দেশের মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা, পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবাদিক-সহ প্রায় ১৭ হাজার ডেলিগেটের অংশগ্রহণে এই সম্মেলনে বিশ্বব্যাপি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভ‚মি ও সমুদ্রসীমা নিয়ে সংরক্ষিত অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে বর্তমানে ১৭ শতাংশ ভ‚মি ও ৭ শতাংশ সমুদ্র সংরক্ষিত রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংরক্ষিত অঞ্চলের সীমা ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও চুক্তিতে ২০৫০ সালের মধ্যে সব প্রজাতি বিলুপ্তির হার নির্দিষ্টভাবে ১০ গুণ কমিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে।
চুক্তি সইয়ের পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, অবশেষে প্রকৃতির সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতির পটভূমিতে এই ‘কাঠামো’ সাধারণত প্রকৃতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে ‘প্যারিস চুক্তি’ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ও তার পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য রক্ষার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ক্যানাডার পরিবেশমন্ত্রী বলেন, এটি এমন এক মুহূর্ত যা ইতিহাসে লেখা থাকবে, প্যারিসে যেমনটা হয়েছিল জলবায়ুর জন্য।
চুক্তিটির প্রশংসা করে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ চুক্তি একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত রয়েছে এমন ৮০ শতাংশ অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের বাস্তুচ্যুতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশ কর্মীরা। যদিও চুক্তিটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদিবাসী ও স্থানীয় স¤প্রদায়ের অধিকারকে সম্মান জানানোর কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হলে কৃষি, ব্যবসার সরবরাহব্যবস্থা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসী স¤প্রদায়ের ভ‚মিকায় বড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
সম্মেলনে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের দাবির প্রেক্ষিতে চুক্তিটি বাস্তবায়নের খরচবাবদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ২ হাজার কোটি এবং এরপর ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে ধনী দেশগুলো। যদিও উন্নত দেশগুলোর আন্তরিকতা ও আগ্রহের অভাবে এই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনগুলোর কোনো প্রতিশ্রæতিই পুরোপুরি পূরণ করা যায়নি কিংবা হয়নি।
উল্লেখ্য, এই সম্মেলনটি ছিল কপ ১৫-এর দ্বিতীয় পর্ব, প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২১ সালের ১২-১৩ অক্টোবর চীনের কুনমিংয়ে। চীনে কভিড-১৯ জনিত কারণে সম্মেলনটি কানাডার মন্ট্রিয়লে স্থানান্তর করা হয়। দুটি জায়গায় অনুষ্ঠিত একই সম্মেলন ও তার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ায় এই চুক্তিকে ‘কুনমিং-মন্ট্রিয়ল’ চুক্তি বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
এই চুক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে চারটি অভীষ্ট ও ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা-সংবলিত ফ্রেমওয়ার্ক গ্রহণ করা হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশগুলো হচ্ছে: জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা কর্মকাÐ নির্বাহের জন্য উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২৫ ও ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে যথাক্রমে দুই হাজার ও তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার অর্থ প্রদান; ২০৫০ সালের মধ্যে সব প্রজাতি বিলুপ্তির হার ১০ গুণ কমিয়ে আনা; ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩০ শতাংশ স্থলজ, অভ্যন্তরীণ জলজ, উপক‚লীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার; ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ ভ‚মি, সমুদ্র, উপক‚লীয় এলাকা, অভ্যন্তরীণ জলাশয় সংরক্ষণ করা; আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি; বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে ওষুধ তৈরির প্রকল্প নেওয়া; কীটনাশক ও বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবহারের ঝুঁকি অর্ধেকে নামিয়ে আনা; বন্য প্রজাতির নিরাপদ ও আইনগত ব্যবহার, ফসল সংগ্রহ এবং টেকসই বাণিজ্য নিশ্চিতকরণ, অতিরিক্ত শোষণ রোধ এবং বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাবগুলি হ্রাস করা; খাদ্য অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা; পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাÐে সরকারি ভর্তুকি কমিয়ে আনা; জেনেটিক সম্পদগুলো ও সেসবের ডিজিটাল সিকোয়েন্স সংক্রান্ত তথ্য এবং চিরায়ত জ্ঞান, সম্পদের ব্যবস্থা এবং ব্যবহারের কার্যকারিতা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে অর্থ প্রদানের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ৭০টি উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিরা বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) সম্মেলনস্থল থেকে বের হয়ে যান। অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পর তারা ফিরে আসেন। বিশ্বের তিনটি বৃহৎ জীববৈচিত্যের দেশ ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গোসহ দক্ষিণের দেশগুলো একটি নতুন জীববৈচিত্র্য তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছিল। তারা বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নির্দিষ্টভাবে ২০৩০ পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তার জন্য ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থ প্রদানের ব্যাপারে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলছে না। মনে রাখতে হবে যে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আছে বিশ্বের গরিব দেশগুলোর মধ্যেই।
এরপরই কানাডা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তহবিল বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার বিশেষ জীববৈচিত্র্য তহবিল গঠনের কথা উল্লেখ না থাকার অভিযোগ তুলে ১৯ ডিসেম্বর চুক্তি পাস হওয়ার আগ মুহূর্তে কঙ্গোর প্রতিনিধি জোরালো বিরোধিতা করেন। ক্যামেরুন ও উগান্ডাও কঙ্গোর পক্ষে অবস্থান নেয়। এ ধরনের একটি অবস্থার মধ্যেই কপ ১৫-এর প্রেসিডেন্ট এবং চীনের পরিবেশ মন্ত্রী হুয়াং রুনকিউ চুক্তিটি পাস হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, চার বছরের যাত্রা শেষ হয়েছে।
চুক্তির বিষয়ে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট বাস্তুতত্ত¡বিদ অধ্যাপক এস পিম বলেন, শুরু হিসেবে এটি অত্যন্ত ভালো এবং এর পরিমাণগত লক্ষ্যগুলো খুবই স্পষ্ট। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব বার্ডসের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জর্জিনা চ্যান্ডলার বলেন, মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের ভালোর জন্যই এই চুক্তিকে স্বাগত জানানো উচিত। এখন সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনকে এসব প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।