মেট্রোরেলে চেপেই বিদেয় হোক সব প্রাগৈতিহাসিক চিন্তা চেতনা
সচলায়তন ব্লগ থেকে নেয়া
নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাছে টৎনধহ Urban Sprawl I Smart Growth শব্দ দুটি খুবই পরিচিত। খুব সোজা কথায় Urban Sprawl বলতে আমরা বুঝি, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রান্ত সংলগ্ন এলাকায় নগরের বিস্তার ও নগরায়ন। বিশ্বের অধিকাংশ নগরই গড়ে উঠেছে ও বিস্তার লাভ করেছে অপরিকল্পিতভাবে। সময়ের সাথে সাথে এভাবে গড়ে ওঠা শহরগুলো যখন তাদের ধারণ ক্ষমতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে থাকে তখন সামাজিক সুযোগ সুবিধাগুলোর ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। এই সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় সত্তরের দশকের শুরুতে নগরায়নের আরেকটি ধারণার জন্ম হয় যা Smart Growth নামে পরিচিত। Smart Growth হল পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক নগরায়ন। এখানে শহরকেন্দ্র থেকে আবাসিক এলাকাগুলো খুব দূরে হবে না, লোকজন পায়ে হেঁটে, সমষ্টিগত বাহনে (বাস, ট্রেন) অথবা সাইকেলে চেপেই গুরুত্বপূর্ণ স্হান গুলোতে যেতে পারবে। এখন কথা হল নতুন শহরগুলো নাহয় পরিকল্পনা করা গেল, কিন্তু যে শহরগুলো ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে তাদের কি হবে? দেখা যাচ্ছে এই পুরোন শহরগুলোতেই মানুষকে আসতে হচ্ছে নানা প্রয়োজনে। একেকটি সড়কেরও নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা থাকে। বড় শহর ও শহরতলীর মধ্যে যোগাযোগের রক্ষা করতে গিয়ে সেই ধারণক্ষমতার মাত্রা অতিক্রম করে। আধুনিক নগরায়নের ধারণায় এ সমস্যা মোকাবেলায় ব্যবহৃত হচ্ছে Mass Rapid Transit,, জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিবর্তে বিদ্যুৎ কিংবা স্রৌ শক্তির ব্যাবহারে বাস (Bus Rapid Transit, BRT) এবং ট্রেন Light Rail Transit, LRT) যোগাযোগ ব্যাবস্থা। এই LRT অধিকাংশ জায়গায় মেট্রোরেল নামেই বেশি পরিচিত। ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের কারণে ইদানিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সোস্যাল মিডিয়া সরব হয়ে উঠেছে। প্রস্তাবিত তিনটি রুটের একটি, MRT-4 নিয়ে বিমান বাহিনীর অভিযোগের কারণে প্রথম প্রকল্পটি জটিলতার মুখে পড়ে। সেই জটিলতা কাটিয়ে উঠেতেই MRT-6 রুটটি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কি অভিযোগ থাকতে পারে তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। প্রবাসে যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে তার একটির ঠিক পাশেই ট্রেন স্টেশন ছিল। সেই ট্রেন নিয়ে ছাত্রদের অনেক অভিযোগ ও অভিমান দেখেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে, এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো ঐ স্টেশনে দাঁড়াতো না এবং প্রতিদিন পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেন ছিল না বলে। পশ্চিমা ও দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিকল্পিত ভাবেই Mass Rapid Transit এর ব্যবস্থা থাকে ছাত্রদের যাতায়াতের কথা বিবেচনা করেই। নেটে একটু ঘাটাঘাটি করলেই অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে। যেখানে পৃথিবীর অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেট্রোরেলের ব্যবস্হা আছে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষকের আপত্তির কারণটা তবে কি হতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, মেট্রোরেলের রুটটি যদি ঢাকা বিশ্ববিদালয় দিয়ে যায়; তাহলে হুমকিতে পড়বে গোটা ক্যাম্পাসের শিক্ষা পরিবেশ। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চারুকলা, টিএসসি ও দোয়েল চত্বর এলাকা। মেট্রোরেলের কারণে কাঁপবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আইকন-স্থাপনা কার্জন হলের একেকটি ইট।
সমাবেশে যোগ দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান বলেন, ‘মেট্রোরেল হলে চাপা পড়বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকারান্তরে চাপা পড়বে দেশের মেধা-মনন। এই ধরণের উন্নয়ন ধারণার সবচেয়ে বড় গলদ হচ্ছে অপরিণামদর্শীতা। ইতিহাস গড়ার বিদ্যাপীঠে এধরণের হঠকারী উন্নয়ন অজস্র জটিলতা নিয়ে আসবে।’
মাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘এই প্রজেক্ট আসলে ফাঁকিবাজির উন্নয়ন। এত বড় একটি প্রকল্প ঢাবি দিয়ে হবে; অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই পাশ কাটিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেলো। এই রেলের কারণে যে কম্পন হবে তাতে কোনোভাবেই বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলোতে গবেষণা কাজ চালানো যাবে না। মেট্রোরেলের তীব্র শব্দে চমকে উঠবে সবাই’।
মেট্রোরেল এবং সাধারণ রেলগাড়ির মধ্যে তফাৎ অনেক। Light Railবিদ্যুৎ ও সৌর শক্তি চালিত, জীবাশ্ম জ্বালানী নয়, এর গতি ও Acceleration Rate অনেক বেশি, এর দ্বারা শব্দ এবং পরিবেশ দুষণ সর্বনি¤œ। বলা যায় একটি প্রাইভেট কারও এর চাইতে বেশি পরিবেশ দূষণ করে। সুতরাং শব্দ দুষণের যে অভিযোগটি করা হচ্ছে সেটিও খুব দুর্বল। নিচের ছবি দুটো তুলনা করলেই বোঝা যাবে যে ময়লাবাহী ট্রাকও মেট্রোরেলের চাইতে বেশি শব্দ দূষণ করে।
মেট্রোরেলের অফিসিয়াল কনসালটেন্ট Delhi Metro Rail Corporation হ শব্দ দূষণ কমাতে রেলের বাঁকগুলোতে ঝবষভ Self Lubricating Wheel প্রযুক্তি ব্যাবহার করে। ধরনা করি এক্ষেত্রেও তারা একই প্রযুক্তি ব্যাবহার করবে।
এবার মেট্রোরেল জনিত ভূ-কম্পনের সমস্যায় আসা যাক। Super Structure Level হয় বিভিন্ন ভাবে ও বিভিন্ন স্তরে। ঝঁঢ়বৎ ঝঃৎঁপঃঁৎব খবাবষ এ ইলাস্টোমেরিক ও পলিমার প্যাডিং এবং Sub Structure Level G Mass Spring I Hydraulic Arm এর সাহায্যে কম্পন মোকাবেলা করা হয়।
এখন কথা উঠতে পারে বাংলাদেশে কি এতসব দূষণ প্রতিরোধ ব্যাবস্হার প্রয়োগ হবে কিনা। MRT-5, 4 এবং 6 G Light Rail প্রযুক্তি, আর এই প্রযুক্তিতে এসব প্রতিরোধ ব্যাবস্হার প্রয়োগ বাধ্যতামূলক। যদি এসবের প্রয়োগ না হয় তখন তাকে খরমযঃ জধরষ না বলে সাধারণ রেলগাড়ি বলা উচিত। আমরা যদি পদ্মা সেতুর বাস্তবতায় বিশ্বাস করতে পারি তবে শব্দ ও কম্পন দূষণমুক্ত মেট্রোরেলের বাস্তবতায় অবিশ্বাস করার মত কোন কারণ আমি দেখিনা। এখনো পরযন্ত মেট্রোরেলের বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ শুনেছি তার সবগুলোই মনে হয়েছে Mass Rapid Transit সম্বন্ধে না জানার কারণ অথবা নিছক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অকারণ। কত ডেসিবলের শব্দে ল্যাবরেটরিতে গবেষনায় অসুবিধে হবে সে হিসেবটা সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষিকা না করে রসায়ন বা পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক-শিক্ষিকারা করুক। প্রযুক্তির চিন্তাটা করুক প্রকৌশলীরা, আর রেলের এ্যালাইনমেন্ট কোন পথে হবে সেটা করুক নগর পরিকল্পনাবিদরা। আশা করছি এই মেট্রোরেলে চেপেই বিদেয় হবে শিক্ষাঙ্গনে জড়ো হওয়া সব প্রাগৈতিহাসিক চিন্তা চেতনা।