আলোচনায় আছে, গবেষণায় নেই বাজারে পাওয়া যায় আমদানি করা ভুট্টার তেল
মতিনুজ্জামান মিটু : দেশে উৎপাদিত ৫৬.৬ লাখ টন ভুট্টা থেকে প্রতি বছর শতকরা ১০ ভাগ হিসেবে প্রায় ৫.৬ লাখ টন কর্ন জার্ম পাওয়া যাবে এবং দুই লাখ টন তেল নিষ্কাশন করা সম্ভব হবে। ৩৫০ টাকা কেজি দরে যার বাজার মূল্য প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর্ন জার্ম আলাদা করার পর বাকি অংমের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে পোল্ট্রি, পশু ও মাছের খাদ্য এবং কর্ন স্টার্চ উৎপাদন করা সম্ভব। ভুট্টা ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করে এর তেলের পরিমাণ শতকরা চার ভাগ থেকে উন্নীত করে ১০ শতাংশের বেশি করা যায়। ‘ভুট্টার তেল উৎপাদন: বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত’ শীর্ষক এক লেখার মতামত ও তথ্যে কৃষি গবেষণা সিস্টেম (নার্স) জাতীয় এমেরিটাস সাইন্টিস্ট ড. কাজী এম.বদরুদ্দোজা এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ এসব কথা জানান। তারা আরো জানান, চাহিদার কথা বিবেচনা করে দেশে ভুট্টার তেল উৎপাদনের কথা এখনই ভাবতে হবে। তাহলে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এমেরিটাস বিজ্ঞানী, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. কাজী এম. বদরুদ্দোজা’র মতে বাংলাদেশেও ভুট্টার তেল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব।
অপর এক সূত্র জানায়, ভুট্টা ভুট্টার তেলের অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড বিশেষ করে লিনোলিক এসিড উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ভুট্টার তেলে থাকা ভিটামিন কে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ভোজ্যতেল হিসেবে ভুট্টা তেলের পুষ্টিগুণ উপলব্ধি করে সয়াবিনসহ অন্যান্য তেলের ওপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণায় সাফল্য লাভ করে। এতে ভবিষ্যতে যাতে দেশে ব্যাপক হারে ভুট্টা তেল ব্যবহার হয় তার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশেই বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা দিয়ে কর্নফ্লেক্স ও কর্ন অয়েল তৈরিতে উদ্যেক্তাদের সংশ্লিষ্ট করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর জানান, বাংলাদেশে ভুট্টা নতুন সম্ভাবনাময় ফসল। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের অনুকূল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতেও ভুট্টার ভালো ফলন হচ্ছে। কৃষকদের কাছেও ভুট্টা চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ফলে ভুট্টার উৎপাদন ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে দেশে জমি ছয় লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে। উন্নত দেশে ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার থাকলেও দেশে শুধু প্রাণি, পোল্ট্রি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত ভুট্টার অধিকাংশই (৯৫ শতাংশ) প্রাণি, হাঁস-মুরগির ফিড ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে, ইদানিং খই ভুট্টা, মিষ্টি ভুট্টা (৫ শতাংশ) হিসেবেও মানুষের খাদ্য হিসেবে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। উন্নত বিশ্বে ভুট্টা থেকে র্স্টাচ, ইথানল, জৈব জ্বালানি, তেল উৎপাদনসহ রয়েছে আরও বহুমুখী ব্যবহার।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র চীন, তুরস্ক, ব্রাজিল, জাপান, ইতালি, বেলজিয়াম, কানাডা, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, স্পেন, মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ভারতসহ বিশ্বের ৫২টিরও বেশি দেশ বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টার তেল উৎপাদন করছে। যার মোট পরিমান প্রায় ৩২ লাখ টন। এসব তেল তারা বিদেশেও রপ্তানি করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অন্যতম প্রধান ভুট্টা উৎপাদনকারী দেশ হলেও ইতালি এবং জাপানের ভুট্টা উৎপাদনের পরিমাণ এদেশের মতোই। তা সত্তে¡ও ইতালি ও জাপান ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদন করছে। চাহিদা থাকায় বাংলাদেশের বাজারেও বিদেশ থেকে আমদানি করা ভুট্টার তেল পাওয়া যায়।
ভুট্টাতেল স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এতে কোন আমিষ বা শর্করা নেই, শতকরা ১০০ ভাগই চর্বি আছে। যার পুষ্টিমান অন্যান্য তেলের চেয়ে বেশি। ভুট্টা তেলের সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড সয়াবিন ও সূর্যমূখী তেলের সমপরিমাণ। ভুট্টা তেলে ভিটামিন ই (টোকোফেরল) এর পরিমাণ সূর্যমূখী তেলের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে ভুট্টা তেলে ভিটামিন কে (১.৯ মাইক্রো গ্রাম) রয়েছে যেখানে সয়াবিন ও সূর্যমূখী তেলে তা অনুপস্থিত। এছাড়াও সালাদ, বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পাউরুটি, মাখন তৈরি করতে ভুট্টা তেল ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. এছরাইল হোসেন ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মুজাহিদ-ই-রহমান জানান, আদিকাল হতে বর্তমান সময়ের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের প্রচেষ্টা যেন নিরন্তর। প্রায় দশ হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যবহৃত হতে থাকে। বাংলাদেশে দানাশস্যের মধ্যে ধান ও গমের পরেই রয়েছে ভুট্টার অবস্থান। ভুট্টার পুষ্টিমান ধান ও গমের চেয়েও বেশি। ভুট্টার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার মোট আবাদি জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ ১.৭৪ লাখ হেক্টর এবং ১১.৩৭ লাখ টন ছিলো। যা বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫.৫৪৪ লাখ হেক্টর এবং ৫৪.০২৫ লাখ টন এ দাঁড়ায়। প্রাণি খাদ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ এবং মাছের খাদ্যে কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ ভুট্টা ব্যবহৃত হয়। ভুট্টায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান থাকায় দেশে পশু-পাখি এবং মাছের খাদ্য হিসেবেও ভুট্টার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ভুট্টা সংযোজন করা গেলে নিঃসন্দেহে তা দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে। ভুট্টার দানাই প্রধানত খাদ্য হিসেবে নেওয়া হয়। ভুট্টায় বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের প্রায় সবকিছুই রয়েছে। ভুট্টায় রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ রাসায়নিক যৌগ যা মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভুট্টা থেকে তৈরি ১০০ এরও বেশি খাদ্য রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৮২টি প্রধান খাদ্য, ১৫ ধরনের পানীয় এবং ১২ টিরও বেশি নাশতা জাতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির উপাদান হিসেবেও এর কোনো জুড়ি নেই। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি সূত্র জানান, এখানো ইনস্টিটিউটে ভুট্টার তেলের বিষয়ে কোনো গবেষণা শুরু হয়নি। তবে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নাসির স্টার্চ, অয়েল অ্যান্ড অ্যানিমেল ফিড ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেড এ বিষয়ে একটি উদ্যোগ নিচ্ছে।