মেগা হাইওয়ে বা মেট্রোরেল আসলে কাদের জন্য
মাহা মির্জা
বর্তমান উন্নয়ন ধারার একটি অন্যতম দিক হলো চোখ ঝলসানো সুবৃহৎ বা মেগা প্রকল্প। শিক্ষা চিকিৎসাসহ সর্বজনমুখী বহুরকম প্রয়োজনীয় কর্মসূচির বদলে এরকম প্রকল্পের ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। এর কারণ প্রথমত, বিপুলাকারের কারণে তা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে মানুষকে মোহাবিষ্ট করা সহজ। দ্বিতীয়ত, এরকম মেগা প্রকল্প দেশি বিদেশি বহুগোষ্ঠীর মুনাফার ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম। সেজন্য এগুলোকে মহিমান্বিত করায় আগ্রহী অনেকে। এগুলোর যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম থেকেই লাভ ক্ষতি বিষয়ে যে মিথ্যাচারের ওপর ভর করা হয় তারও প্রমাণ বহুবিধ। এসব প্রকল্প যেসব প্রতিশ্রæতি দিয়ে শুরু হয় তা পূরণ হবার বদলে জনগণের জন্য যে বিপদের কারণ হয় তারও বহু প্রমাণ আছে।
প্রশ্ন ওঠে: মহাসড়ক কি শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মিত হয়? মহাসড়কের সুফল কি সাধারণ মানুষ পায় না? এক্সপ্রেস হাইওয়ে, বৃহৎ সেতু বা ফ্লাইওভার কি সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না? অবশ্যই করে। কিন্তু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা দরিদ্রবান্ধব থাকছে না।এক. বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, রূপসা, পাকশী, মেঘনা-গোমতীসহ দেশের প্রায় অর্ধশত সেতুতে অতিরিক্ত টোল আদায়ের ফলে সাধারণ মানুষ এসব অবকাঠামোর অর্থনৈতিক সুবিধা বা সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাৎ, অতিরিক্ত টোল আদায়ের ফলে বড় সেতু বা হাইওয়েগুলো শেষ পর্যন্ত দরিদ্র জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী থাকছে না।
দুই. সুলভে গণপরিবহণের ব্যবস্থা না-করেই বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভারের মতো অতিরিক্ত খরচবহুল মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করার ফলে জনসাধারণের পরিবহণ ব্যয়ভার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, অতিরিক্ত মেট্রো ভাড়ার কারণে রাজধানীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে নিয়মিত মেট্রোরেল ব্যবহার করা সম্ভব হবে কি না-এই প্রশ্ন উঠেছে।
তিন. ইজিবাইক এবং অটোরিকশা মহাসড়কে চলবে-কি-চলবে না, এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে হাইকোর্টে একের পর এক রিট করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইন করেই অটোরিকশা বা ইজিবাইকের মতো সুলভ বাহনগুলোকে হাইওয়ে বা মহাসড়কে চলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এ রকম বহু এলাকা আছে, যেখানে কৃষিপণ্য পরিবহণ, রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া বা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র ভরসা ভ্যান অথবা ইজিবাইক এবং এই বাহনগুলোকে একপর্যায়ে মহাসড়কে উঠতেই হয়। গ্রামীণ স¤প্রদায় এবং জেলা শহরগুলোর বাড়ন্ত চাহিদা আমলে নিয়ে মহাসড়কগুলোর সঙ্গে সার্ভিস রোড সংযুক্ত করা তাই অপরিহার্য। মহাসড়কগুলো এমনিতেই চীন বা ভারতের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ খরচে তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, দুর্নীতি বা কমিশন বাণিজ্যের কারণে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে । অথচ প্রায় অর্ধলক্ষ অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালক সুষ্ঠু সার্ভিস রোডের অভাবে হাইওয়ে ব্যবহার করার অনুমোদন পাচ্ছে না। অর্থাৎ, বিপুলসংখ্যক নি¤œ আয়ের মানুষের প্রতিদিনকার ব্যবহার করা পরিবহণটি বিপুল খরচে নির্মিত মহাসড়কগুলোতে নিষিদ্ধ। চার. যোগাযোগ অবকাঠামোর একটি বড় অংশই জ্বালানি পরিবহণের উদ্দেশ্যে নির্মিত হচ্ছে, যা জনসাধারণের ব্যবহার করার সুযোগ নেই। যেমন: বহুল খরচে নির্মিত সমুদ্রবন্দর, ফ্লোটিং টার্মিনাল, টার্মিনালের সঙ্গে সংযোগ সড়ক ইত্যাদি খরচবহুল প্রকল্প জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত নয়।অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, গণপরিবহণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ না করে মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোগুলোতে অতিরিক্ত বিনিয়োগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিবহণ খরচ বেড়েছে এবং বহুলাংশেই এই অবকাঠামোগুলো তাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে।(আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত সংকলন সর্বজন কথা থেকে সংক্ষেপে নেয়া)