নির্বাচিত গণতন্ত্র স্বৈরাচারি রূপকেও হার মানিয়েছে
বিডি রহমতউল্লা :
৯০ পরবর্তী ৩২ বছরের মধ্যে ২ বছর সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিলে গত প্রায় ৫০ বছর নির্বাচিত বেসামরিক সরকারদেশ পরিচালনা করছে। এই ৫০ বছর নির্বাচিতমুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার শাসনরুপ এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনরুপের চেয়ে কম স্বৈরাচারী রূপে আমরা দেখছি না। বরং মুৎসুদ্দিবুর্জোয়াদের নির্বাচিত সাধারণ গণতন্ত্র কোন কোন ক্ষেত্রে সামরিক স্বৈরাচারী আচরণকেও হার মানিয়েছে। ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা, খুন, গুম, লুটসহ মিছিল-মিটিং করার অধিকার ও বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ, দলীয়করণ, দুর্নীতি, সম্পদ পাচার এহেন কোন কাজ নেই যা তারা করছে না এবং এর জন্য কোন জবাবদিহিতার বাল্ইা তাদের নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যম হিসাবে পার্লামেন্ট চালু থাকলেও তাকে ঠুটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। কায়েম করা হয়েছে সাধারণ গণতন্ত্রের অধীনে আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণির দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, অর্থনীতি ও এক বর্ব্বরমূলক ফ্যাসীবাদী স্বৈরতান্ত্রিক দূঃশাসন। ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়নের স্বার্থে বেড়েছে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীলতা। গণতান্ত্রিক কোন কাঠামোতো বিকশিতই হয়নি বরং পশ্চাদপদ আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব রাজনীতির অনুসঙ্গ হিসাবে বিকশিত হয়েছে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। আবার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার নামে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী বাম ও সংশোধনবাদীরা মুৎসুদ্দিবুর্জোয়াদের একাংশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছে এবং তাদের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা পালন করছে। অপরদিকে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তি ক্রমাগত জনগণ থেকে বিছিন্ন হচ্ছে যথাযথ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে ব্যর্থতার জন্য।
বিপ্লবী সংগ্রামের জোয়ার-ভাটার সাথে সম্পর্কিত করেই রণকৌশল পরিবর্তন করতে হয়। রণনীতি বিহীন রণকৌশল জন্ম দেয় সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদের আবার রণকৌশলহীন রণনীতি জন্ম দেয় সংকীর্ণতা ও নৈরাজ্যবাদের। রণকৌশল রণনীতির অধীন। রণনীতির সেবা করাই রণকৌশলের কাজ।
জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণকৌশল সাধারণ গণতন্ত্রের রণকৌশলের বিপরীত। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হলো সাম্রাজ্যবাদ, আমলা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও সামন্তাবাদী শ্রেণী। আর বিপ্লবের চালিকাশক্তি হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত (পেটিবুর্জোয়া) শ্রেণী যার নেতা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। জাতীয় বুর্জোয়া ও ধনী কৃষকরা হচ্ছে এই বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র। সামাজ্যবাদের দালাল আমলা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও সামন্তাবশেষ শ্রেণীর রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহকে চুড়ান্তভাবে পরাজিত করেই কেবল বিপ্লবীদের পক্ষে চুড়ান্তবিজয় অর্জন করা সম্ভব। শাসক গোষ্ঠির রাজনৈতিক দলসমূহ ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল হিসাবে এবং এই শোষণমূলক রাষ্ট্রকে রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন সময় জাতীয় ও জনগণের পক্ষের নানা দাবী ও ইস্যুনিয়ে কথা বলে। রাষ্ট্রের প্রত্রিক্রিয়াশীল চরিত্র ও তাদের ভাঁওতাবাজিকে আড়াল করার প্রয়োজনে সংবিধানেও অনেক ভালভাল কথা লিখে রাখে । এসবই হচ্ছে তাদের জনগণের সাথে প্রতারণাপূর্ণ কাজের অংশ। তাই এসব দল শাসক গোষ্ঠীর কোন অংশের সাথে সমান্তরাল, সমাভিমূখী, যুগপৎনানা কৈাশল ব্যবহার করে তাদের লেজুড়ে পরিণত হলেও জনগণের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটি পরোক্ষভাবে আড়াল করতে চেষ্টা চালায়। জনগণ শাসক শ্রেণী থেকে মোহমুক্ত হওয়ার পরিবর্তে কোন না কোন অংশের প্রতি কোন না কোন ইস্যুতে আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারে । সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রাম, এমনকি যুদ্ধাপরাদীদের বিচার যে উদাহরণ্ই্ দেই না কেন প্রত্যেকটি ইস্যুতে মুৎসুদ্দিবুর্জোয়া শ্রেণীর শাসক গোষ্ঠীর সাথে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। তারা লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্র রক্ষা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল হিসাবেই কিছু সংস্কারমূলক বা গণতান্ত্রিক দাবী উত্থাপন করে। এখানে মুৎসুদ্দি-বুর্জোয়াদের বস্তুভিত্তিক দুর্বলতার কারণেই তাদের সংসদ পন্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। ফলে তা বারবার সংকটের মধ্যে পড়েছে। তাই মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসনতন্ত্রের সামরিক-বেসামরিক রূপ চক্রাকারে আবর্তিত হয়েছে। শাসক শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থার যে রূপই থাকুক না কেন তাতে রাষ্ট্রীয় চরিত্রের মৌলিক হেরফের ঘটেনি। তাই বিষয়টি কেবল রাষ্ট্রীয় শাসন রূপের নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। তার অর্থ এই নয় যে, বিপ্লবীরা সামরিক-বেসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে না। মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার রাজনৈতিক দল সমূহ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সংসদ পন্থার জন্য আর কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের রণধ্বনি হচ্ছে সামরিক শাসনের উৎত্থাতের মধ্যে দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করা। তাই কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের রণকৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে শাসক শ্রেণীর রাষ্ট্র, শুধু শাসন রূপের পরিবর্তন নয়। এই দুই শ্রেণীর রণকৌশলগত বক্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যের সীমারেখা টেনেই কেবল জনগণকে বুর্জোয়া রাজনীতির মোহগ্রস্ততা থেকে মুক্ত করে বৈপ্লবিক রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ ঘটানো সম্ভব। (সাবেক ডিজি পাওয়ার সেল)