দেশে বছরে অপচয় আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি মাছের খাদ্য পানি দূষণসহ নষ্ট হয় পরিবেশ
মতিনুজ্জামান মিটু: এঅপচয় রোধ করা গেলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশের পুকুরগুলোর পরিবেশ সঠিক মাত্রায় সংরক্ষণের মাধ্যমে মাছের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হবে। দেশে বর্তমানে চাষ করা মাছের উৎপাদন ও আবাদ এলাকা বাড়ছে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ হারে। ২৬ লাখ টন চাষকরা মাছের মধ্যে শুধু পুকুরেই মাছের উৎপাদন ছাড়িয়েছে ২০ লাখ টন। বাড়তি জনগণের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে মাছ চাষের বিপল্প নেই। এজন্য দরকার উন্নত মানের মৎস্যখাদ্য।
বিভিন্ন উৎস্যের বরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এস এম রফিকুল ইসলাম, রিসার্চ ফেলো নাজিয়া তাসনিম ও রিসার্চ ফেলো মো. হাবিবুর রহমান জানান; মাছচাষ বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান শিল্প। ধারাবাহিক উৎপাদন বাড়ার মাধ্যমে বর্তমানে দেশে মাছের উৎপাদন হয় ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন। যার শতকরা ৫৭ ভাগ আসে চাষ থেকে। নদীমাতৃক এদেশে ৩৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে রয়েছে মিঠাপানির মুক্ত জলাশয়। এছাড়াও রয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা লাখ লাখ পুকুর। আবাহমানকাল থেকেই মাছ চাষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের জীবন। মাছ চাষে ৬৮ থেকে ৭০ শতাংশ খরচ হয় মাছের খাবার যোগানের পেছনে, যার ৬০ ভাগ কাঁচামাল আমদানি নির্ভর। এরওপর খাদ্য অপচয় এবং পচনে পানির দূষণসহ নানাবিধ সমস্যাতো রয়েছেই। এতে ব্যহত হচ্ছে মাছের স্বাভাবিক বিকাশ। ফলে মৎস্যখাতে দেশের অর্জন অসামান্য হলেও তা ¤øান করে দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ মৎস্যখাদ্যের অপচয়।
বিভিন্ন উৎস্যের পরিসংখ্যানমতে, দেশে প্রতিবছর গড়ে মাছের ৩৫ হাজার টন ভাসমান খাবার এবং সাত থেকে আট লাখ টন ডুবন্ত খাবার অপচয় হচ্ছে। মূলত খাবার প্রয়োগে ভুল পদ্ধতি অনুসরণ ও পুকুরে চাষ পদ্ধতিতে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এবিপুল পরিমাণ মৎস্যখাদ্য নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মৎস্যখাদ্যের বাজারব্যাপ্তি পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এর অর্ধেকই নষ্ট হয় পানিতে। ফলে মাছের খাদ্যের অপচয় রোধ করা গেলে একদিকে যেমন দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব, অন্যদিকে পুকুরের পরিবেশ সঠিকমাত্রায় সংরক্ষণের মাধ্যেম উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক বলেন, ‘মাছের খাদ্যের অপচয় হয়। তবে প্রচারে যতটা আছে, ততটা নয়। এবিষয়ে গবেষনার দরকার আছে। মাছের খাদ্যের অনেক উপাদানের সঙ্গে এনজাইমও আমদানি করা হয়।’
‘মৎস্যখাদ্যে এনজাইমের ব্যবহার: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা’ প্রসঙ্গে প্রফেসর ড. এস এম রফিকুল ইসলাম জানান, মাছের খাদ্যের খরচ কমানোর ক্ষেত্রে এনজাইম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মাছের খাদ্যের উচ্চমূল্যের অন্যতম কারণ হলো মাছের খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের ব্যবহার। প্রাণিজ আমিষের বদলে উদ্ভিজ্জ আমিষ ব্যবহারে দাম অনেক কমিয়ে আনা যায়।
এক ধরণের জৈবরাসায়নিক অনুঘটক এনজাইম বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বিক্রিয়ার গতিকে তরান্বিত করে। শিল্পকারখানায় বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণে এনজাইম তৈরী করে থাকেন। এটি ফিড এডিটিভ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। মৎস্যখাদ্যে এনজাইমের ব্যবহার মাছের বিপাক ক্রিয়া বাড়ায়। এছাড়াও জটিল উপাদানগুলোকে সরল উপাদানে রুপান্তর করে। ফলে অল্প পরিমাণ খাবার সরবরাহ করে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। এতে একদিকে মাছের খাদ্যের অপচয় কমে, অন্যদিকে এন্টি নিউট্রিশনাল উপাদানগুলোকে নিষ্ক্রিয় করায় উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের শোষণ সহজ হয়।
এনজাইম অ্যান্টি-নিউট্রিশনাল উপাদানগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে মৎস্যখাতে উদ্ভিজ্জ আমিষ ব্যবহারে মাছের খাদ্যের খরচ ও অপচয় কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব কারণে বর্তমানে সারা বিশ্বে পোল্ট্রি ও মৎস্যখাদ্যে এনজাইমের ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিবিধ উপকারিতায় বাংলাদেশেও এনজাইমের ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত এসব এনজাইম ভারত, ভিয়েতনাম, নেদারল্যান্ড, জার্মানী ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা হয়। যা এদেশের মাছের প্রজাতিভেদে নির্দিষ্ট নয়। এছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এনজাইম, মাছের খাদ্যে আগে মিশানো অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। এতে এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে প্রকৃতপক্ষে এদেশের মাছ চাষিরা প্রকৃতপক্ষে এনজাইমের সুফল এখনও পাচ্ছেন না। গবেষণার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া থেকে দেশের পরিবেশ উপযোগী এনজাইম উৎপাদন সম্ভব হলে তা সঠিকভাবে মাছেরখাদ্যে ব্যবহারে মাছ চাষে টেকসই উন্নয়ন আনা সম্ভব হবে।