বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ পানির সংকট, হুমকির মুখে খাদ্য নিরাপত্তা ২০৫০ সাল নাগাদ চরম পানি সংকটে পড়বে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ
এম. মোশাররফ হোসাইন: গত শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে পানির চাহিদা। কিন্তু চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি, যেটি আগামী শতকে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এভাবে সংকট ঘনীভূত হতে থাকলে শিগগিরই মানবজাতির জন্য অশুভ সময় ঘনিয়ে আসছে। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকট থাকা দেশগুলোতে বসবাস করছে। এমতাবস্থায় জলবায়ু সংকট আরো প্রবল হলে বৈশ্বিক সুপেয় পানির সংকট আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নিরাপদ পানি প্রাপ্তিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার পরও বিশ্বের ৭৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এ সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। অনিরাপদ পানীয় জলের কারণে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইউনিসেফ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী নিরাপদ পানির সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুই-তৃতীয়াংশের বাস ১০টি দেশে, যার মধ্যে চীন, ভারত, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে সব জলীয় উৎসের মাত্র ২.৫ শতাংশ মিঠা পানি এবং তন্মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ পানিই কেবল মানুষের হাতের নাগালে। সুতরাং পৃথিবীর মাত্র ০.০০০৭ শতাংশ পানি ব্যবহার উপযোগী, যা ৬.৮ মিলিয়ন মানুষের খাবার পানির উৎস।
বিজ্ঞানীরা পানির সংকটের পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়, এসবের ফলে বিশুদ্ধ পানির উৎস নষ্ট হয়ে সেখানে সংকট দেখা দেয়। উপরন্তু, অতিরিক্ত খরার কারণে সাব-সাহারার আফ্রিকার ৮০ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং সমুদ্রের লবণাক্ত পানির স্তর বৃদ্ধির ফলে, বিভিন্ন উৎসের পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
ক্রমবর্ধমান পানির সংকট বিশ্বব্যাপী চরম অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবল ঘাটতি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। আমেরিকার ওয়াটার ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন (এডবিøউডবিøউএ) তাদের সর্বশেষ গবেষণায় জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সা¤প্রতিক অস্থিরতার পেছনে রয়েছে পানি সম্পদের বিপর্যয়। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষি খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের অভাবে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে নাগরিক জীবন। দেখা দিচ্ছে প্রবল গণঅসন্তোষ।
২০১১ সালে মিসরে খাদ্য শস্যের উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, তার কারণও ছিল ওই পানি সংকট। ভবিষ্যতে মিসরের সঙ্গে ইথিওপিয়ার পানি নিয়ে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ভারতের পানির উৎসের তুলনায় চাহিদা বেশি। ভবিষ্যতে তা সংকটজনক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। পানি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে ভারত। ২০১৮ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পানি সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। দেশটির সরকারি একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে খাওয়ার পানির নির্ভরযোগ্য কোনো উৎসের সুযোগ থাকবে না।
চীনেও রয়েছে পানির ব্যাপক সংকট। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় ভূগর্ভস্থ পানির ৭০ শতাংশই মানব স্বাস্থ্যের অনুপযোগী। আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে চীনের প্রায় তিন কোটি মানুষ পানির অভাবে অভিবাসী হয়ে যেতে পারে। ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে বেইজিং।
২০৩৫ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এত বিপুল চাহিদার জোগান নিয়ে আতঙ্কে আছে উন্নত বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া তাদের জ্বালানি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির সংকটে পড়তে পারে।
জাতিসংঘের পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালনাগাদ চরম পানি সংকটে পড়বেন বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী তিন দশক ধরে প্রতিবছর বিশ্বে পানির ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সরবরাহের প্রচলিত উৎস খাল ও বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বেড়ে যাবে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা। কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির এক-চতুর্থাংশই আর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির অর্ধেকই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। কিন্তু এর অব্যবস্থাপনার কারণে এই সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। তাই ভূগর্ভস্থ অধিক পানি উত্তোলনের ফলে উপক‚লীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানায়, ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দ্রæত ফুরিয়ে আসছে। পাশাপাশি সংস্থাটি সারাবিশ্বের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতাকে। তাদের তথ্যমতে, বিশ্বের ৬৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ পানযোগ্য পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মানসম্মত পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে আরো প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি হবে ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। দেশে দেশে পানির স্বল্পতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদ বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে এবং এ কারণে নিরাপদ সুপেয় পানি প্রাপ্তি হবে আগামী বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ।
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত এক জার্নালে বলা হয়েছে, বায়ুমÐলে মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টিকারি ‘ফরেভার কেমিক্যাল’ এত বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে যে নতুন এক নির্দেশিকায় বৃষ্টির পানিকে এখন পান করার ক্ষেত্রে অনিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছে।
এমনিতেই বিশ্বের অনেক দেশেই নিরাপদ পানির সংকট রয়েছে। সেসব দেশে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানিকেই বিবেচনা করা হত। এখন সেই পানিকেও অনিরাপদ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।