আখ চাষ ও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্পে সংকট কেন(২)
মোশহিদা সুলতানা
ও কল্লোল মোস্তফা
বাংলাদেশের চিনিশিল্পের ইতিহাসের মতোই চিনিশিল্পের সংকটের ইতিহাসও বহুদিনের। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো শুরু থেকেই নানা অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনের শিকার। চিনিকলের সাথে সম্পর্কিত চাষিদের হয়রানির ইতিহাসও বহু পুরনো। সত্তরের দশকের শেষ বছরে নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে এক তরুণ আখচাষির পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার কার্যকারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দেখেছিলেন, আখচাষিরা আখের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, আখ বিক্রি করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হয়ে আখ উৎপাদনে নিরুৎসাহ হচ্ছে এবং কারখানায় আখ বিক্রির বদলে গুড় উৎপাদনকারীর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে, রাষ্ট্র আখচাষিকে প্রণোদনার মাধ্যমে আকৃষ্ট করার বদলে গুড় নিয়ন্ত্রণ আইন, পুলিশি নির্যাতন এবং গুলি চালিয়ে পর্যন্ত আখ বিক্রি করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। চিনিশিল্পের সংকটের কারণ হিসেবে আখচাষিদের এই সমস্যা ছাড়াও তিনি আরো তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছিলেন : পুরনো যন্ত্রপাতি, মিলের অভ্যন্তরে দুর্নীতি ও সুষ্ঠু চিনি নীতির অভাব (মুহাম্মদ, ১৯৮০)। এই সমস্যাগুলোর প্রায় সবই এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে, কোনো কোনোটি আরো তীব্র হয়েছে। সা¤প্রতিককালে চিনি আমদানি উদারীকরণের ফলে চিনিশিল্পের এই সংকট আরও বেড়েছে।
গত চার বছরে (২০১১-১৪) চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন চিনির দাম কমিয়েছে পাঁচবার। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার যখন দাম কমানো হয়, তখন প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৬০ টাকা। সেই চিনির দাম নেমে এসেছে ৩৭ টাকায়। কিন্তু যখনই চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন দাম কমায়, তার চেয়েও দু-তিন টাকা কমে বাজারে চিনি বিক্রি করে বেসরকারি চিনি পরিশোধনকারীরা (প্রথম আলো, ২০১৫)। সরকারি চিনিকলগুলোর দর যখন ৪০ টাকা করা হয়, তখন বেসরকারি চিনিকল সিটি গ্রæপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতি কেজির উৎপাদনব্যয় পড়েছে সাড়ে ৪৩ টাকা। কিন্তু আমরা ডিলারদের দিচ্ছি ৪২ টাকায়।’ উৎপাদনব্যয়ের চেয়ে কম দামে কেন চিনি বিক্রি করছেন- জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ‘উপায় কী! সুগার করপোরেশন চিনি দিচ্ছে ৪০ টাকায়। আমাদেরও তো চিনি বিক্রি করতে হবে। সে কারণে কম দামে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে।’ বেসরকারি চিনিকলগুলো চিনি বিক্রিতে যতটুকু ‘লোকসান’ দিচ্ছে তা অন্য ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে (যেমন:ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা) ক্রেতাদের কাছ থেকে তুলে নিচ্ছে (প্রথম আলো, ২০১৪)।
ওপরে উল্লিখিত সংকট বিবেচনায় শিল্প মন্ত্রণালয় চিনির শুল্ক বাড়াতে দুটি প্রস্তাব দেয়। একটি হচ্ছে অপরিশোধিত চিনির স্পেসিফিক ডিউটি বহাল রেখে সংরক্ষণমূলক শুল্ক ২০ থেকে ৪০ শতাংশে পুনর্র্নিধারণ। অন্যটি হচ্ছে স্পেসিফিক ডিউটি ও সংরক্ষণমূলক শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে রিফাইনারিগুলোর এক্সগোডাউন পর্যায়ে বিক্রয়যোগ্য চিনির দামের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ। পরে চিনির আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আরোপের এই প্রস্তাব সংবলিত এনবিআরের পাঠানো সারসংক্ষেপে অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দেন। এনবিআরের পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়, পরিশোধিত-অপরিশোধিত চিনির ট্যারিফ মূল্য বৃদ্ধি ও ভ্যাট আরোপের ফলে চিনির দাম কেজি প্রতি যথাক্রমে সাড়ে ৫ ও ৭ টাকা বাড়তে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি ট্যারিফ মূল্য ৩২০ থেকে ৩৫০ ডলার এবং পরিশোধিত চিনির ট্যারিফ মূল্য ৪০০ থেকে ৪৩০ ডলার করা হলো (বণিক বার্তা, ২০১৫)।
এছাড়া প্রজ্ঞাপন জারি করে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট আরোপ ও শুল্ক পুনর্র্নিধারণ করায় কেজি প্রতি চিনির মূল্য প্রায় ১১% বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ সংরক্ষণমূলক বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোকে উৎসাহিত করতে গিয়ে এর ভার পড়ছে ভোক্তার ওপর। কিন্তু ভোক্তার ওপর ভার বাড়িয়ে কি চিনিশিল্পকে সংকট থেকে উদ্ধার করা সম্ভব?
১.চিনির বাজার সংকটের কারণ অনুসন্ধান
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১৫টি চিনিকলের বার্ষিক চিনি উৎপাদনক্ষমতা ২.১ লাখ মেট্রিক টন (বিএসআইএফসি, ২০১৪)। উৎপাদনক্ষমতার এই হিসাবটি করা হয়েছে ২৬ লাখ মেট্রিক টন আখ থেকে ৮ শতাংশ হারে চিনি উৎপাদন ধরে নিয়ে (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক), অর্থাৎ এই উৎপাদনক্ষমতার হিসাব শুধু স্থাপিত যন্ত্রপাতির ক্ষমতা বা লোকবলের ওপর নয়, বরং নির্ভর করে আরও অনেক বিষয়ের ওপর; যেমন-পর্যাপ্ত আখ উৎপাদন, আখের গুণগত মান, কত দক্ষতার সাথে আখ মাড়াই করে অধিক চিনি আহরণ করা যায়, যন্ত্রাংশের কার্যকারিতা এবং আখ সংগ্রহ থেকে শুরু করে উৎপাদিত চিনি রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত সার্বিক সমন্বয় সাধনের দক্ষতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সর্বনিু চিনি উৎপাদন হয় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে (১৯,৬০৪ মেট্রিক টন) এবং সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদন হয় ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে (২.৭ লাখ মেট্রিক টন) (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)। শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণে চিনি উৎপাদনের এই তারতম্য হয় না, বরং অনেকগুলো বিষয় দ্বারা মোট উৎপাদন প্রভাবিত হয়। এই প্রবন্ধে উৎপাদন সম্পর্কিত এই প্রতিটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে পরবর্তী অংশে। এই অংশে মূলত কিভাবে উদারীকরণ নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিনিশিল্পের বিকাশকে নিরুৎসাহ করেছে এবং সংকট ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রেখেছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।