উৎপাদিত ইউরিয়া সারের ভর্তুকির অর্থ পাচ্ছে না বিসিআইসি
সোহেল রহমান : ছয় বছর ধরে দেশীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ইউরিয়া সারের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না। সরকার তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে কম দামে তথা ভর্তুকি মূল্যে ইউরিয়া সার বিক্রি করায় গত ছয় অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)-এর উৎপাদন পর্যায়ে আর্থিক ক্ষতি বা ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।
সাধারণভাবে ভর্তুকির এ অর্থ কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিশোধের কথা রয়েছে। কিন্তু দেশে সারের চাহিদা মেটাতে সংস্থাটি কর্তৃক বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সারের ভর্তুকি মূল্য পরিশোধ করা হলেও অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত সারের ভর্তুকি মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে না। এমতাবস্থায় অতি সম্প্রতি সরাসরি অর্থ বিভাগের মাধ্যমে ভর্তুকির এ অর্থ পরিশোধের দাবি জানিয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে নীতিগত অনুমোদনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ভর্তুকির অর্থ আদায়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের কথা থাকলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের আবেদন জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সারের ভর্তুকির অর্থ নিয়মিত পরিশোধের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিসিআইসি’র হিসাব মতে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ইউরিয়া সারের দাম আমদানিকৃত সারের তুলনায় কম হওয়ায় বিসিআইসি’র ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের পরও ছয় বছরে সরকারের প্রায় ৮ হাজার ৭৪৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে।
অন্যদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ২০.৮৩ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলার সঙ্কটের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে অনীহা প্রকাশ করায় ইউরিয়া সার আমদানি বর্তমানে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশীয় কারখানায় ইউরিয়া সারের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা শিথিল করা না গেলে দেশে সার সঙ্কট দেখা দিতে পারে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে বলে মনে করে শিল্প মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী বিসিআইসি’র আওতাধীন সার কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ইউরিয়া সার ডিলার পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। গত ছয়টি অর্থবছর (২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২০২২) ধরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ও নির্ধারিত দরে (প্রতি টন ১৪,০০০ টাকা) ডিলাদের কাছে ইউরিয়া সার সরবরাহ করে আসছে সংস্থাটি। সে হিসাবে ছয়টি অর্থবছরে উৎপাদন পর্যায়ে বিসিআইসি’র মোট পুঞ্জিভূত আর্থিক ক্ষতি বা ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
বিসিআইসি’র হিসাব মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিজস্ব উৎপাদনে সরবরাহকৃত ৮.২৪ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের বিপরীতে মোট আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৭০ কোটি টাকা (আলোচ্য অর্থবছরে প্রতি টন সারের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ১৯ হাজার ৭০৪ টাকা); ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরবরাহকৃত ৭.৬৫ লাখ টনের বিপরীতে মোট আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৭৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা (আলোচ্য অর্থবছরে প্রতি টন সারের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার ৫৪৭ টাকা); ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরবরাহকৃত ৬.৮৪ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে মোট আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২১৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা (আলোচ্য অর্থবছরে প্রতি টন সারের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ১৭ হাজার ২০১ টাকা); ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরবরাহকৃত ৭.৯৬ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে মোট আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৪৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা (আলোচ্য অর্থবছরে প্রতি টন সারের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ১৯ হাজার ৬২৭ টাকা); ২০২০-২১ অর্থবছরে সরবরাহকৃত ১০.৩৪ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে মোট আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা (আলোচ্য অর্থবছরে প্রতি টন সারের উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৮ হাজার ৩৯৬ টাকা) এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে সরবরাহকৃত ১০.১০ লাখ টনের বিপরীতে মোট আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫০৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা (আলোচ্য অর্থবছরে প্রতি টন সারের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ১৯ হাজার ২ টাকা)।
মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সম্প্রতি সরকার কর্তৃক গ্যাসের দাম প্রতি ঘন মিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা নির্ধারণ করায় ইউরিয়া সারের উৎপাদন ব্যয় বর্তমানের তুলনায় প্রায় দ্বি-গুন হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে আনুমানিক ৮ লাখ টন সার সরবরাহের বিপরীতে উৎপাদন পর্যায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দীর্ঘদিন যাবৎ বিসিআইসি কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দরে ইউরিয়া সার বিক্রি করে যাচ্ছে, যা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। ফলে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর বড় অঙ্কের আর্থিক লোকসান দিচ্ছে এবং বর্তমানে বিসিআইসি’র আওতাধীন সার কারখানাগুলো তীব্র নগদ তারল্য সঙ্কটে রয়েছে। জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বর্ধিত হারে গ্যাসের মূল্য পরিশোধে বার বার তাগিদ দেয়া হলেও বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় সার কারখানাগুলো চ‚ড়ান্তভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সংস্থার আওতাধীন ছয়টি কারখানার মধ্যে বর্তমানে চারটি চালু রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি কারখানা ৩৫ বছরের অধিক পুরাতন হওয়ায় এগুলোর ধারাবাহিক উৎপাদন সক্ষমতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। অর্থের অভাবে কারখানাগুলোর নিয়মিত ওভারহোলিং, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কাঙ্খিত মাত্রায় উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।
অর্থ বিভাগের হিসাব মতে, বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিসিআইসি অন্যতম। গত সাত বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি টানা লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আলোচ্য ছয়টি অর্থবছরে (২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২০২২) বিসিআইসি’র পুঞ্জিভুত নীট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪১০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের নীট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৭৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।