ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি : সিপিডি জরীপ
সোহেল রহমান : বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে গত পঞ্জিকা বছরে (২০২২ সাল) বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের অগ্রগতি হয়নি। আগের বছরের তুলনায় এটি হয়তো স্থবির ছিল বা আরও খারাপ হয়েছে। তবে অন্যান্য কাঠামোগত এবং নতুন নতুন সমস্যার ফলে দুর্নীতির তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসা পরিবেশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন ব্যবসায়ীরা। রোববার সংস্থার ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ বিজনেস এনভায়নমেন্ট স্টাডি ২০২২ : ফাইন্ডিং ফ্রম দ্য এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিং-এ জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মিডিয়া ব্রিফিং-এ জানানো হয়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডবিøউইএফ)-এর বার্ষিক ‘এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে’র বাংলাদেশ অংশটির জরীপ চালিয়েছে সিপিডি। জরীপে গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৭৪ জন বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মতামত নেয়া হয়।
ব্রিফিং-এ জরীপের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, জরীপে অংশগ্রহণকারী ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ উদ্যোক্তা মনে করেন যে, দেশের ব্যবসায় প্রধান বাধা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি। এ প্রসঙ্গে যেসব খাতগুলো এসেছেÑ এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন কর প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি; ৫৪ শতাংশ বলছেন লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি; গ্যাস ও বিদ্যুৎ নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৪৯ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জরিপে যেসব সূচকের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে প্রথম সূচক রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে শুধু উৎপাদন খরচ নয়, সেবার মূল্যও অনেকখানি বেড়ে যায়। এই মূল্যের ঘানিটা সাধারণ মানুষেরই ওপর পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে শুধু ব্যবসার পরিবেশ নয়, অর্থনৈতিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুর্নীতি ছাড়াও ব্যবসার অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর বিষয়ে বলা হয়, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জ, দুর্বল আমলাতন্ত্র, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার উত্থান-পতন ও নীতিগত সমস্যা ইত্যাদিও ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধক।
জরীপে ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা নেয়া; সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একটি বড় সংস্কার নিশ্চিত করা; আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা; নাগরিক এবং ব্যবসায়িক সেবা নিশ্চিত করা; ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; আর্থিক খাতের সংস্কার; নির্বাচনী ইশ্তেহারে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ করার অঙ্গীকার করা।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দুর্নীতির পাশাপাশি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ব্যবসাকে আরও সমস্যায় ফেলছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে বৈদেশিক মুদ্রার উত্থান-পতন, আমলাতন্ত্র ও মূল্যস্ফীতি। আর বড় ব্যবসায়ীদের জন্য এসবের পাশাপাশি অবকাঠামোর অপ্রতুলতা সমস্যার সৃষ্টি করছে। এছাড়া জীবন-যাত্রার মান বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদার আচরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নির্বাচনের বছরে সামাজিক ও রাজনৈতিক অশান্তি আরও বাড়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এসএমই উদ্যোক্তারা ঋণ পায় না। এক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়ে দেয়া দরকার। পুঁজিবাজার আগের মতোই দুর্বলতা রয়েছে। আর্থিক খাতে সুশাসন আনার ক্ষেত্রে সরকার যে আশ্বাস দিয়েছে, বিশেষ করে ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আইএমএফ-এর সঙ্গে সরকার সুশাসনের যে কথা দিয়েছে, সেখান থেকে কাজ শুরু হতে পারে। সেখানে আর্থিক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে ঋণ খেলাপিদের কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এফডিআই আনার ক্ষেত্রে আমরা সেরকম সম্ভাবনা দেখছি না। বিদেশি বিনিয়োগ সমানভাবে আকৃষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কর কাঠামো সংক্রান্ত জটিলতা, অবকাঠামোগত ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতা ও দক্ষ জনবলের অভাবের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশের নীতি কাঠামো যখন করা হয় তখন সবার জন্য করা হয়। কিন্তু ছোট, মাঝারি ও বড়দের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নীতি দরকার। খাত ও আকারভিত্তিক উদ্যোগ দরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থঋণ আদালতের সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে বন্দর সুবিধাগুলোর বিষয়ে অধিকাংশ ব্যবসায়ী অদক্ষ মনে করে। যা জরীপে এসেছে।