বছরের পর বছর আলোচনায় আছে উৎপাদন নেই সম্ভাবনাময় ভূট্টার তেল
মতিনুজ্জামান মিটু : আমদানি করা ভুট্টার তেল দিয়েই মেটাতে হয় এদেশের বাজারের চাহিদা। অথচ দেশে বর্তমানে ৫৬.৬ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয়। সম্ভাবনাময় ভুট্টার তেল প্রসঙ্গে কৃৃষি স¤প্রসারণ অফিসার কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম জানান, শতকরা ১০ ভাগ হিসেবে তা থেকে ৫.৬ লাখ টন কর্ন জার্ম পাওয়া যেতে পারে এবং ২ লাখ টন তেল নিষ্কাশন করা সম্ভব। এদুই লাখ টন ভুট্টার তেলের বাংলাদেশে বাজারদাম প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা (৩৫০ টাকা কেজি বাজারমূল্য হিসেবে)। তাছাড়া, কর্ন জার্ম আলাদা করার পর বাকি অংশ (প্রায় ৯০শতাংশ) ব্যবহার করে পোল্ট্রি, পশু ও মাছের খাদ্য এবং কর্ন স্টার্চ উৎপাদন করা সম্ভব। তেল নিষ্কাশনের পর যে খৈল পাওয়া যাবে তাও পোলট্রি, পশু ও মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশে ভুট্টা নতুন সম্ভাবনাময় ফসল। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের অনুক‚ল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতেও ভুট্টার ভালো ফলন হচ্ছে। কৃষকদের কাছেও ভুট্টা চাষ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। ফলে ভুট্টার উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০২-০৩ অর্থবছরে এদেশে মোট ভুট্টার উৎপাদন ছিল মাত্র ১৭৫ লাখ টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার মোট আবাদি জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ ১৭৪ লাখ হেক্টর এবং ১১৩৭ লাখ টন ছিলো। যা বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে যথাক্রমে ৪৬৩৫০০ লাখ হেক্টর জমিতে ৫৬৩০৬৭১ টন এ দাঁড়িয়েছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮ হাজার ৩০০ লাখ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৫৬৩৭ লাখ টন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, তুরস্ক, ব্রাজিল, জাপান, ইতালি, বেলজিয়াম, কানাডা, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, স্পেন, মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ভারতসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশ বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টার তেল উৎপাদন করছে। যার মোট পরিমান প্রায় ৩২ লাখ টন। এসব তেল তারা বিদেশেও রপ্তানি করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অন্যতম প্রধান ভুট্টা উৎপাদনকারী দেশ হলেও ইতালি এবং জাপানের ভুট্টা উৎপাদনের পরিমাণ এদেশের মতোই। তা সত্তে¡ও ইতালি ও জাপান ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদন করছে।
বিভিন্ন সূত্রের বরাতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ জানান, পুষ্টিবিদদের মতে ভুট্টার তেল একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ভোজ্যতেল। প্রায় সব ধরনের রান্নায় এতেল ব্যবহার করা যায়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-ই (১০শতাংশ) ও ভিটামিন-কে (১শতাংশ। এর ফ্যাটি এসিড কম্পোজিশন অনেকটা সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, তুলাবীজ, তিল ও তিসি তেলের মতোই। এতে রয়েছে ৫৫থেকে ৬২ শতাংশ ওমেগা-৬ এবং ১.১ শতাংশ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এক টেবিল চামচ (১৩ গ্র্রাম) ভুট্টার তেলে রয়েছে ১২২.৪ কিলোকেলোরি শক্তি, মোট ফ্যাট-১৩ গ্রাম, স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট- ১.৮ গ্রাম, মনোআনস্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট-৩.৮ গ্রাাম, পলিআনস্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট- ৭.৪ গ্রাম, ওমেগা-৬৭.২ গ্রাম ও ওমেগা-৩ ০.২ গ্রাম। এতেল ব্যাবহারের ফলে রক্তের কোলস্টরলের উন্নয়ন হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ও হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হয়, দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, পেটের দাহ নিয়ন্ত্রণ করাসহ নানাবিধ উপকার রয়েছে। সুস্বাদু, মিষ্টি গন্ধ ও সুন্দর রংয়ের জন্য এভোজ্যতেল বেশি জনপ্রিয়। রান্নার তেল ছাড়াও ভুট্টার তেল বায়োডিজেল, সাবান, রং, কালি, ওষুধ তৈরির পাশাপাশি পোশাক শিল্পে বিশ্ববাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
ইকোনোমিক রিপোর্টার ফোরামের তথ্য মতে, বাংলাদেশ গত বছর ১৭ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করে ১৮ লাখ ১৮ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানী করে দেশের চাহিদা মেটানো হয়। চাহিদা থাকায় বাংলাদেশের বাজারেও বিদেশ থেকে আমদানি করা ভুট্টার তেল পাওয়া যায়। এসব আমদানি করা ভোজ্যতেলের সঙ্গে সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল থেকে দেশেজ উৎপাদন (প্রায় ৩ লাখ টন) যোগ করে দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদা নিরূপণ করা যায়, যা প্রতি বছর কম-বেশি ২১ লাখ টন (মতান্তরে ২৪ লাখ টন প্রতি বছর)।