বাংলাদেশে কেন বিবর্তনবাদকে পড়তে দেয় না
মুজিব রহমান
কিভাবে আমরা বলি আধুনিক মানুষের বয়স মাত্র ৫০ হাজার বছর? মানুষ প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে ২-৩ লক্ষ বছর কিংবা আমাদের পূর্বপুরুষের বয়ষ ৫০-৬০ লক্ষ বছর? সোজা কথায় উত্তর হলো ফসিলের হিসাব মিলিয়ে। মানুষের বয়স ৫০ হাজার বছর আগের হোম সেপিয়ান্স বা প্রথম আধুনিক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তারপর দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ ছড়িয়ে পড়ে সাহারা আর আরবের মরভূমি পার হয়ে এশিয়া এবং ইউরোপে। তারপর সারা বিশ্বে। এখন যদি ৭৫ হাজার বছর আগের কোন ফসিল পাওয়া যায় তবে আধুনিক মানুষের বয়স বেড়ে হবে ৭৫ হাজার বছর। তবে ৯০ হাজার বছর আগে যে মানুষের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে তা আধুনিক মানুষ নয়। তারা মানুষের পূর্ববর্তী প্রজাতির অবশ্যই। তা থেকেই ধারণা করা হয় পূর্ববর্তী আবিষ্কারগুলোর মতো ৯০ হাজার বছর থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর আগে মানুষ আফ্রিকা ত্যাগ করতে শুরু করেছিল। সা¤প্রতিককালে ইসরাইলে এমন এক মানুষের চোয়ালের যে ফসিল পাওয়া গেছে তা আফ্রিকার মানুষেরই হবে। যদিও এই প্রাচীন মানুষটির কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য আধুনিক মানুষের সাথে মিল থাকলেও সে দেখতে সম্ভবত আলাদাই ছিল। এ সময় যে মানব ফসিল পাওয়া গেছে তারা আধুনিক মানুষের মত ছিল না। তাইওয়ানে দুই লক্ষ বছর আগের মানুষের চোয়ালের ফসিল পাওয়া গেছে। ওই চোয়াল আধুনিক মানুষের নয় তবে মানুষ প্রজাতির। সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ ১৫ হাজার বছর আগের মানুষ প্রজাতির করোটির ফসিল পাওয়া গিয়েছে। তা থেকে আমরা বলি মানুষ প্রজাতির যাত্রা শুরু হয়েছে ওই সময় থেকে। যদি কখনো ৪ লক্ষ বছর আগের মানুষ প্রজাতির ফসিল পাওয়া যায় তাহলে ধারণাও পাল্টাবে। ৩২ লক্ষ বছর আগের এক নারীর ফসিল পাওয়া গেছে যাকে আমরা মানুষের পূর্বপুরুষ বলি। এটা মানুষ প্রজাতি নয় তবে মানুষের পূর্বপুরুষ। ফসিলটি একজন নারীর এবং তাঁর নাম দেয়া হয়েছে লুসি। স¤প্রতি পাওয়া গেছে আরো আগের অর্থাৎ ৪৪ লক্ষ বছর আগের ফসিল, তার নাম দেয়া হয়েছে আর্ডি। এখন আমরা বলতে পারি ৪৪ লক্ষ বছর আগেও আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল। আমরা দেখি ৪৪ লক্ষ বছর আগের মানুষের পূর্বপুরুষ আর ৩২ লক্ষ বছর আগের পূর্বপুরুষ এক নয়। বিভিন্ন ধাপে পরিবর্তিত হতে হতে আধুনিক মানুষ পাওয়া যাচ্ছে। যদি ৫০ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের ফসিল পাওয়া যায় তবেই মানুষের বিবর্তনের বিষয়টি বদলে যাবে। সেই ধাক্কায় বাতিলও হয়ে যেতে পারে বিবর্তনবাদ। তবে যদি ১০ কোটি বছর আগের মানুষের ফসিল পাওয়া যায় তবে নিশ্চিতভাবেই বাতিল হয়ে যাবে বিবর্তনবাদ। আসুন আমরা অনুসন্ধান করতে থাকি এতো পুরাতন কালের মানুষ পাওয়া যায় কি না?
কোথা থেকে এলাম? কিভাবে সবকিছু চলছে? এমন প্রশ্নের অবতারণা থেকে ধর্মের আবির্ভাব? সৃষ্টিবাদ সামনে নিয়ে এসেছে অলৌকিকতা? তারা ভেবেছে চন্দ্র-সূর্যই দেবতা। তারাই সব চালাচ্ছে। আবার সন্দেহ এসেছে। মানুষ নতুন কিছু ভেবেছে। তারা নিয়ে এসেছে দেবদেবী? তাদের মধ্যে সন্দেহ এসেছে। তারা দেখেছে দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করে কিছু হচ্ছে না। রোগ থেকে বাঁচে না, ঝড়-বন্যা থামে না, যুদ্ধে জেতা যায় না, খাদ্য সংকট দূর হয় না। কিন্তু তাদের জ্ঞান সীমিত । কিছু মানুষ নিয়ে আসে নতুন ধারণা একেশ্বরবাদ! কিন্তু অগ্রসর মানুষ তবুও সন্দেহ করে? আবার কিছু মানুষ আঁকড়ে থাকে আগুন বা সূর্য বা দেবতা বিশ্বাসে।
বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাণের ধারণা প্রথম করেন গ্রীক দার্শকগণ। থেলিস ভেবেছিলেন সকল প্রাণির উদ্ভব হয়েছে পানি থেকে। অ্যারিস্টটল ধারণা দেন- অজৈব বস্তু থেকেই জৈব বস্তু সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে দীর্ঘকাল আর কথা বলা যায়নি খৃষ্ট ধর্মের প্রভাবের কারণে। শক্তিশালী হয়ে ওঠা ধর্মগুলোও চিন্তার জগৎকে থামিয়ে দেয়। ধর্মগুলোতে পূর্ববর্তী চিন্তার প্রকাশ স্থির হয়ে রয়েছে। নতুন চিন্তাতো আসতেই থাকে? নতুন চিন্তা যেহেতু স্থির চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক তাই তা গ্রহণ করা হতো না। নতুন চিন্তা আসলেই তাকে দমন করা হতো। তবুও ইউরোপের দার্শনিকরা অন্ধকার যুগ পেরিয়ে কথা বলা শুরু করে। নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। ডারউইন প্রমাণসহ নিয়ে আসেন বিবর্তন তত্ত¡। পাশ্চাত্য অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্তি পায়।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার মতো দেশগুলোতে ধর্ম নিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। ধর্ম বিশ্বাসের সাথে জড়িয়ে আছে বহু ব্যবসা, বাণিজ্য ও জীবিকা! কোটি কোটি মানুষ নির্ভর হয়ে আছে ধর্মের সাথে। কোটি কোটি মানুষ ধর্ম শিক্ষা নিয়ে, তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে? গড়ে উঠেছে প্রার্থনালয়, শিক্ষালয়, গবেষণালয়। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রয়েছে ধর্মীয় বিষয়ের শিক্ষক। ধর্মীয় পুস্তক বাণিজ্যেও জড়িয়ে আছে বহু মানুষ? তৈরি হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। এ ভীত তারা আরো শক্ত করতে চায়। তারা অনবরত বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রমাণিত সত্য বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে? বিবর্তনকে বিতর্কিত করতে ছড়ায় মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য। আর সঠিক বিবর্তন প্রচারে ঘটাতে থাকে বিঘœতা? পাঠ্য পুস্তক বা মিডিয়ায় বিবর্তনবাদ আসলেই তারা ধর্ম অবমাননার কথা বলে তা নিষিদ্ধ করাতে তৎপরতা চালায়। তারা বিবর্তনবাদ পড়া থামাতে চায়। তারা জানে এই সত্য জ্ঞান এমন এক সুনামি বয়ে আনবে যা মিথ্যার উপর দাঁড়ানো ভীত কাঁপিয়ে দিবে। মানুষ সহজেই সত্যটা বুঝে ফেলবে। তবে বাস্তবতা হল এভাবে সত্য আটকে রাখা যায়নি। মানুষ আগুন-সূর্য থেকে এসেছে দেবতা বিশ্বাসে সেখান থেকে একেশ্বরবাদে। সেখান থেকে আধুনিক বিজ্ঞান উত্তরণ করেছে। এখন বিবর্তনবাদেন জ্ঞানের সুনামি আসবেই। লেখক : ব্যাংকার