তবুও বিবর্তন ঘটে! যেভাবে প্রমাণ পাই?
মুজিব রহমান
সব জীবই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। বিবর্তনবাদ হচ্ছে জীববিদ্যার সব শাখার অন্যতম ভিত্তিমূল, একে ছাড়া জীববিদ্যাই অচল হয়ে পড়বে। জীব স্থির নয় বরং বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের পরিবর্তন ঘটে আসছে, তাদের কাউকেই পৃথক পৃথকভাবে তৈরি করা হয়নি। তারা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তন বা পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতিতে বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানত এই পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে। ম্যাক্রো-বিবর্তনের মাধ্যমে পূর্বসুরী প্রজাতি থেকে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে হাজার, লক্ষ এমনকি কোটি বছর লেগে যেতে পারে। প্রজাতি হচ্ছে এমন এক জীবসমষ্টি যারা নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম, অর্থাৎ তারা অন্য প্রজাতির সাথে প্রজননগত দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। বিবর্তন ঘটে অত্যন্ত মন্থর গতিতে, প্রাকৃতিক নির্বাচন, মিউটেশন, জেনেটিক ড্রিফট, ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা, বংশীয় বা জেনেটিক রিকম্বিনেশনসহ বিভিন্ন কারণে প্রজাতির মধ্যে ছোট ছোট পরিবর্তন বা মাইক্রো-বিবর্তন ঘটতে থাকে। আর বহু মাইক্রো-বিবর্তনের মাধ্যমে ঘটা সম্মিলিত পরিবর্তনের ফলশ্রæতিতে এক সময় প্রজাতি বা প্রজাতিটির একটি অংশ অন্য আরেকটি প্রজাতিতে পরিণত হয়। অনেক সময় মেগা বিবর্তন বা বিবর্তনে উল্লম্ফন ঘটে। এগুলো এক প্রজন্মে ঘটে না, বিশেষ কোন সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ বছরের পরিবর্তে হাজার হাজার বছর লাগে এই তড়িৎ বিবর্তনগুলো ঘটতে। প্রজাতির উদ্ভব বা জীবের ম্যাক্রো-পরিবর্তনের তত্ত¡টি আজকে ফসিল রেকর্ড ছাড়াও আধুনিক বিজ্ঞানের বহু শাখার সাহায্যে বহু উপায়ে পরীক্ষা করা যায়। কোন পর্যবেক্ষণ যখন বারংবার বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয় তখন তাকে আমরা বাস্তবতা বা সত্য বলে ধরে নেই।
পানির মাছ থেকে স্থলচর চারপায়ী প্রাণির বিবর্তন কিংবা সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণির বিবর্তনের প্রত্যেকটি ধারাবাহিক ধাপের অসংখ্য ফসিল পাওয়া গেছে। ফসিল রেকর্ডে উভচর প্রাণীর উৎপত্তির আগে কোন সরীসৃপের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না আবার সরীসৃপের আগে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত এমন কোন স্তরে এমন একটি অদ্ভুত ফসিলও পাওয়া যায়নি যা দিয়ে বিবর্তন তত্তে¡ র ধারাবাহিকতাকে ভুল প্রমাণ করা যায়। মানুষ এক ধরনের এপ থেকে বিবর্তিত হয়েছে, এখন যদি দেখা যায় এপ জাতীয় প্রাইমেট তো দূরের কথা স্তন্যপায়ী প্রাণী উৎপন্ন হওয়ার অনেক আগে সেই ক্যামব্রিয়ান যুগেই মানুষের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে তাহলেই বিবর্তনের তত্ত¡ ভেঙ্গে পড়বে। এককোষী প্রাণি, বহুকোষী প্রাণি, মাছ, উভচর প্রাণি, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণিদের ফসিলগুলো তাদের বিবর্তনের ধারাবাহিক স্তর ছাড়া অন্য পূর্ববর্তী কোন স্তরে পাওয়া যায়নি। আধুনিক জেনেটিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শিম্পাঞ্জীর জিনের সাথে মানুষের জিন প্রায় ৯৯% মিলে যাচ্ছে আর ডিএনএ-এর সন্নিবেশ এবং মুছে যাওয়া ধরলে এই মিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৬%। মানুষ এবং শিম্পাঞ্জী প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে একই পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন ও সাইটোসিন দিয়ে সকল জীবের ডিএনএ গঠিত অর্থাৎ সকল জীবের উৎপত্তি একই উৎস থেকে বিবর্তিত। জীব জগতে গড়ে ১.৭৬ কোটি বছরে একটি এমাইনো এসিড প্রতিস্থাপিত হয়েছে। প্রাণি ও উদ্ভিদ একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে ৭৯.২০ কোটি বছর আগে। সরিসৃপ ও স্তন্যপায়ীদের পৃথক হতে সময় লেগেছে প্রায় ৩০ কোটি বছর।
সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ অর্থাৎ পৃথিবীর উৎপত্তি ঘটে। অগ্নিগোলক থেকে প্রাণের উৎপত্তির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হতে লেগে যায় শত কোটি বছর। এসময় আদিম ও সরলতম অকোষি জীবের আবির্ভাব ঘটে। সেটাই প্রাণের ইতিহাসের সূচনা, ওখান থেকেই শুরু হয় বিবর্তনের ইতিহাস। এই ইতিহাসের এখন পর্যন্ত শেষ ধাপে মাত্র দুই/তিন লক্ষ বছর আগে মানুষ প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে। আধুনিক মানুষের রূপ এসেছে মাত্র ৫০/৬০ হাজার বছর আগে। দেড় লাখ বছর থেকে ৫০/৬০ হাজার বছর আগ পর্যন্তও পৃথিবীতে মানুষের ভিন্ন প্রজাতির বাস ছিল। মাত্র ১২ হাজার বছর আগেও ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেন্স দ্বীপে বাস করতো ১ মিটার উচ্চতার ভিন্ন প্রজাতির বামন মানুষ হবিট। তাদের ৭ লাখ বছর আগেকার পূর্বপুরুষদের ফসিল গবেষণা করে জানা যায়, এ দ্বীপে প্রথম পা ফেলা স্বাভাবিক আকৃতির মানবেরা মাত্র তিন লাখ বছরের মধ্যেই ১ মিটার উচ্চতার হবিট হয়েছিল।
৮০ লাখ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে এক ধরনের এপ প্রজাতি দুই পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে শেখে। এই যে সাড়ে তিনশ কোটি বছর ধরে প্রাণের পরিবর্তন অনবরত ও আকস্মিকভাবে ঘটছে তার নিদর্শন পাই মাটির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণির ফসিল থেকে। ম্যামথ আর ডাইনোসারদের আমরা পেয়েছি ফসিল থেকেই। ওই যুগের কোন প্রাণিই এখন পৃথিবীতে নেই। আবার উল্টোও বলতে পারি আজকের পৃথিবীর কোন স্তন্যপায়ী পশুই ডাইনোসদের যুগে ছিল না। একটি হাতিকেও আমরা ম্যামথদের সাথে চলতে দেখিনি, আজকের হাতিদের সাথে একটি ম্যামথও চলে না। এখনতো শুধু ফসিল নয়, ডিএনএ বিশ্লেষণ করেও বহু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানের আরো বহুদিক দিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিবর্তনের প্রায় অভিন্ন ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। এ থেকেই বলা হয়, পৃথিবীর সব প্রাণিই একই আদি জীব বা পূর্বপুরুষ থেকে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপত্তি হয়েছে। তারমানে জীবজগৎ স্থিতিশীল নয় বদলে যাচ্ছে। এটাই বিবর্তন। কোটি কোটি বছরের এই বিবর্তনই জীবের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির। এই বিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই ঘটে। কখনো আকস্মিক বড় পরিবর্তন ঘটে কখনো অতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়। তারমানে উচু গাছের পাতা খাওয়ার চেষ্টা করতে করতে জেব্রারা জিরাফ হয়নি। প্রাকৃতিক নির্বাচনেই আদি কোন প্রাণি থেকে বিবর্তন হয়ে জিরাফ হয়েছে, জেব্রা হয়েছে, বানর হয়েছে, মানুষ হয়েছে?