আগাছা ও ছত্রাকনাশকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি
মতিনুজ্জামান মিটু : বালাইনাশক কিছুটা কমলেও বিগত ১০ বছরে দেশে আগাছা এবং চত্রাকনাশকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বেড়েছে মৃত্যু ঝুঁকিও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এর বরাতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের একটি সূত্র জানায়, ২০১২ সালে দানাদার, তরল ও পাউডার মিলিয়ে দেশে ২০৬৩৬.১৮ টন বা লিটার বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছিল। ২০২১ সালে যা কমে হয়েছে ১২৮২২ টন বা লিটার। আর এসময়কালে ৩,৬২৩.৯৪ টন বা লিটার হতে প্রায় দ্বিগুন বেড়ে ২০২১ সালে ৭,৬৫৪ টন বা লিটারে দাঁড়িয়েছে আগাছানাশকের ব্যবহার। চত্রাক ও ইঁদুরনাশকের ব্যবহার হয়েছে ১৮,২১৫ টন বা লিটার ও ৮৫ টন বা লিটার। যা ২০১২ সালে ছিল যথাক্রমে ১৬,৪৭৭.৮১ টন বা লিটার ও ৮৯.৮১ টন বা লিটার। ২০২১ সালে দেশে মোট ৩৮,৯০৬ টন বা লিটার এবং ২০১২তে ৪১,১৪৫.৭৪ টন বা লিটার বালাইনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ও ইঁদুরনাশক ব্যবহার করা হয়।
এপ্রসঙ্গে সুত্র আরও জানায়; ২০১২ সালে ৪১,১৪৫.৭৪ টন বা লিটার এবং ২০২১ সালে ৩৮,৯০৬ টন বা লিটার বালাইনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ও ইঁদুরনাশক ব্যবহার হয়। এতে পার্থক্য দাঁড়ায় ৮৩০৪২০০ টন বা লিটার। টন বা লিটার প্রতি ১৭০ টাকা হারে যার দাম হয় ৮৩ কোটি টাকা। এতে বালাইনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ও ইঁদুরনাশক বাবদ সরকারের সাশ্রয় হয় ৮৩ কোটি টাকা।
সেক্স ফেরোমন’ ফাঁদের ব্যবহারসহ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কার্যকর করা, সুষম সারের ব্যবহার, বালাইনাশক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো, উদ্ভুদ্ধকরণ এবং প্রশিক্ষণে দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমছে। তবে শাকসবজি, ডাল, তেল এবং মসলাজাতীয় ফসলের আবাদ ও ফলবাগান স্থাপনের সংখ্যা বাড়ায় আগাছা ও ছত্রাকনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এর সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক (পেস্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিলেন্স এন্ড ফোরকাস্টিং) কৃষিবিদ মো. এমদাদ হোসেন শেখ বলেন, শ্রমিকের মজুরী ও শাক সবজির আবাদ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দেশে আগাছা ও ছত্রাকনাশকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
এদিকে কৃষিসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কমছে কীটনাশক ব্যবহার। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে কৃষি উদ্যোক্তাদের অনেকেই কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন।
নিরাপদ খাদ্য প্রচারণার জনপ্রিয়তা, কৃষিকাজে নিয়ন্ত্রিত কীটনাশক ব্যবহারে সরকারের সমর্থন এবং চাষিদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোয় দেশে কীটনাশক ব্যবহার দিন দিন কমছে।
উদাহরণ হিসেবে আশুলিয়ার কৃষি উদ্যোক্তা রাজিয়া সুলতানার উদ্ধৃতি দিয়ে সুত্র জানায়; ৩৫ বিঘা (১১.৫৭ একর) জমিতে তিনি ক্যাপসিকাম, ব্রæকলি, বিট রুট, চেরির মতো দামি শস্য উৎপাদন করেন। গোবর, ভার্মি কম্পোস্ট-সহ নানা প্রকারের জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে এনেছেন রাজিয়া।
তিনি বলেন, ‘দামি শস্য ও সাধারণ শস্যের জন্য একই পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। আবশ্যক না হলে ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয় না। করলেও পরিমিত মাত্রায়।
শুধু এই উদ্যোক্তাই নন, কৃষি উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে ঝুঁকছেন। অনেকে আবার জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বালাইনাশকের ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক কৃষক ব্যবহার করছে ভেষজ বালাইনাশক। একারণে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার, যা নিরাপদ ফসল উৎপাদনের একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছে বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং কাজ করে কীটনাশকের লাইসেন্সিং ও মনিটরিং নিয়ে। এই উইং থেকে পাওয়া ১০ বছরের কীটনাশক ব্যবহারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোটা দাগে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ত কমছে।
সুপারিশকরা মাত্রায় সার ও কীটনাশক ব্যবহারে উপকারভোগী কৃষকদের ধান চাষে হেক্টরপ্রতি ১১ শতাংশ, সবজি চাষে হেক্টরে ২৩ শতাংশ এবং ফল চাষে ১৪ শতাংশ খরচ কমেছে। তথ্যমতে, ২০১১ সালে সারা দেশে কীটনাশকের ব্যবহার হয়েছে ৪৪,৪২৩ টন, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৭৫৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এসে কীটনাশকের ব্যবহার নেমেছে ৩৮,৯০৬ টনে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন (১ম সংশোধিত) শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বিভাগের এপ্রকল্পের মূল্যয়নে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই তথ্যেমতে প্রকল্প নেওয়ার আগের চেয়ে বর্তমানে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১৪.২৬ শতাংশ এবং কীটনাশক ব্যবহার ২৯.৮৪ শতাংশ কমেছে।