
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনের মাধ্যমে খোঁজ খবর রাখছেন : কুমুদীনি হাজং

শাহীন খন্দকার : জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বৃটিশ বিরোধী টঙ্কো আন্দোলনের, মহীয়সী নারী নেত্রী কুমুদীনি হাজংকে দেখতে যান। শনিবার কুমুদীনি হাজং এর নিজ বাড়ী দূর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেরাতলী গ্রামের বাড়ীতে যান তিনি।
এ সময়ে প্রেসক্লাবের সভাপতি তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। একই সঙ্গে তাকে আর্থিক সহযোগিতাসহ শীতবস্ত্র উপহার দেন। ফরিদা ইয়াসমিনকে কাছে পেয়ে কুমুদীনি হাজং আবেগাপ্লæত হয়ে বৃটিশ বিরোধী জমিদার প্রথা ও আনন্দোলনের স্মৃতি চারণ করেন। কুমুদিনী হাজং বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তার খোঁজ খবর রাখছেন। স্থানীয় প্রশাসন প্রতিমাসে তার জন্য চাল, ডাল-তেল পিয়াজ আদা রসুনসহ ফল দিচ্ছেন। শুধু তাই নয় মাছ মাংস দুধের জন্য টাকা ও দিচ্ছেন। এ বিষয়ে সুসং দূর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাজীব-উল-আহসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি পিআইওর মাধ্যম্যে এই মহীয়সি কুমুদীনি হাজংয়ের জন্য খাবার, ফল ও টাকা পাঠিয়ে থাকি। শুধু তাই নয় তার শারীরিক চিকিৎসার জন্য স্থানীয় উপজেলা সরকারী হাসপাতালের একজন চিকিৎসক কুমুদীনি হাজংয়ের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
কুমুদীনি হাজং বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি হাফ বিল্ডিং ঘর ও করে দিয়েছেন। এর পূর্বে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেনও তাকে একটি (ফ্লোর পাকা) টিনের ঘর করে দিয়েছিলেন। ফরিদা ইয়াসমিনের নিকট বৃটিশ জমিদারের নির্যাতনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বার বার তার দু চোখ জলে ছলছল করে। তিনি কান্নাকে চেপে সেই সব দিনগুলি বর্ণনা করেন। বয়সের ভারে ন্যুয্য হয়ে পড়লেও মনের দিক থেকে তিনি এখনো চিরসবুজ। চলাফেরা করেন একাই। তবে চোখের দৃষ্টি, কানের শ্রবণ শক্তি কমে এসেছে তার।
এক প্রশ্নের জবাবে কুমুদীনি হাজং বলেন, বৃটিশ সরকারের নির্ধারিত জমিদার প্রথা ও টঙ্কো আন্দোলনের বিরুদ্ধে অত্রঞ্চলের নৃ-তাত্বিক হাজং স¤প্রদায় কমরেড মনিসিংহের নেতৃত্বে দূর্বার আনন্দোলন গড়ে তুলেন। সেই আন্দোলনে স্বামী লঙ্কেশ্বর সঙ্গে তিনিও যোগদেন। হাজং এলাকায় কৃষক বিদ্রোহ দমনকারী বৃটিশ মিলিটারিদের হাত থেকে কৃষক বধূ সরস্বতী কুমুদীনি হাজংকে বাঁচাতে গিয়ে হাজং মাতা রাশিমনি হাজং দায়ের আঘাতে এক বৃটিশ সৈন্যের দেহ মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। এই মৃত্যুর দৃশ্য দেখে বৃটিশ এক সৈন্যের গুলিতে রাসিমনি হাজংকে গুলি করলে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন রাশি মনি হাজং। সোমেশ্বরী নদীর ধারে বহেরারতলী গ্রামে হাজং বিদ্রোহে শঙ্খমণি, রেবতী, নীলমণি, পদ্মমণিসহ আরো অনেকে শহীদের রক্তের স্্েরাতে সবুজ ঘাস ফসলের জমি রক্ত রাঙা হয়ে উঠে। এ বিষয়ে স্থানীয় সাবেক এম পি মোস্তাক আহমেদ রুহী বলেন, আমাদের জন্মের বহু পূর্বের ইতিহাস।
তিনি বলেন, শুনেছি বহেরা তলী গ্রামের সেই ঘটনার সরেজমিনে তদন্ত করতে ভারতের সাবেক মুখ্যোমন্ত্রী জ্যোতি বসু, ব্যারিস্টার স্নেহাংশুকান্ত আচার্য, গারো পাহাড় অঞ্চলের হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আসেন।
কিন্তু তৎকালীন ময়মনসিংহের জেলার বৃটিশ সরকার দ্বারা নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাস্টিন তাদের বহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করতে দেননি, বলে শুনেছি। সাবেক এই এমপি আরো বলেন, পুলিশের গুলিতে সুরেন্দ্রনাথ নামক অপর একজন কর্মী মারা যান।এই খবর পেয়ে চতুর্দিকের কৃষক জনগণ বৃটিশ পুলিশ বাহিনীকে ঘিরে ফেলে,তীর ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে। সংঘর্ষে দুইজন পুলিশ মারা যায় ও অন্যান্যরা পালিয়ে যায় ভারতের আজকের মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার দিয়ে,পাহাড় টিলা অতিক্রম করে।
কুমুদিনী হাজং নৃ-তাত্বিক সম্প্রদায়ের একজন বাংলাদেশী। কুমুদীনি হাজংকে নিয়ে ১৯৯১ সালে খন্দকার শাহীন আফরোজ(শাহীন খন্দকার)দৈনিক ইত্তেফাক পরবর্তীতে মাতৃভুমিতে টঙ্কো আন্দোলন ১৯৪৬-৫০ সাল এ এলাকার নৃ-তাত্বিক হাজং সম্প্রদায়ের কৃষক দ্বারা পরিচালিত একটি আন্দোলনের ওপর লিখেন।
পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কুমুদীনি হাজংকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন এবং লিখছেন। তবে শাহীন খন্দকারের পূর্বে চারণ সাংবাদিক মোনাজাত হোসেন ও দৈনিক সংবাদে লিখেছেন। টঙ্কো প্রথা সুসং দূর্গাপুরের সাধারণ মানুষের উৎপন্ন ফসল জমিদারদের খাজনা বাবদ পরিশোধ করতে হতো। জনশ্রæতি রয়েছে, এই খাজনার পরিমান টাকা দ্বারা পরিশোধের চেয়ে বেশি ছিল। হাজং স¤প্রদায় এ ব্যবস্থায় দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে পরে। ঝড়-জলোৎচ্ছাস, বন্যা অতিখড়ায় ফসল উৎপাদন হতো না। তারপরেও জমিদারকে খাজনা বাবদ ফসল না দেওয়া হলে নেমে আসতো নির্যাতন।
অত্রএলাকায় আরো জনশ্রæতি রয়েছে, সুসংয়ের জমিদার গভীর অরণ্যে থেকে হাতি ধরার কাজে নিয়োজিত করতেন হাজংদের। হাতি শিকার করে জমিদার বাড়ীর পশুশালায় হাতি সংরক্ষণ করা হতো এবং বৃটিশ সরকারকে উপহার দিতেন সুসংয়ের জমিদার। গভীর অরণ্যে হাতি ধরতে গিয়ে শতশত হাজং সম্প্রদায়ের মানুষকে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে জীবন দিতে হয়েছে।
এ সময় সুসং দুর্গাপুরের জমিদারদের ভাগ্নে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ টঙ্কো প্রথা উচ্ছেদ, টঙ্কো জমিদার স্বত্ব, নিরিখসহ টঙ্কো প্রথা বাতিলসহ বকেয়া টঙ্কো মওকুফ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি নিয়ে আনন্দোলনের ডাক দেন। সেই সময়ে মনিসিংহের নেতৃত্বে হাজং সম্প্রদায় জীবন ও জীবিকার স্বার্থে টঙ্কো আনন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন। সেই আনন্দোলনের সুত্র ধরেই স্বামী লঙ্কেশ^র হাজংসহ তার তিন ভাই টঙ্কো আনন্দোলনের নেতৃত্বে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন এবং নেতৃত্ব দেন।
ইতোমধ্যে এই মহীয়সি নারীকে সমাজসেবায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দিয়েছে বাংলা একাডেমি। এ ছাড়া তিনি অনন্যা শীর্ষদশ (২০০৩), ড. আহমদ শরীফ স্মারক (২০০৫), কমরেড মণি সিংহ স্মৃতি পদক (২০০৭), সিধু-কানহু-ফুলমণি পদক (২০১০), জলসিঁড়ি (২০১৪) ও হাজং জাতীয় পুরস্কার (২০১৮) পেয়েছেন।
তার ছেলে অর্জুন বলেন, আমার বৃটিশ বিরোধী টঙ্কো আন্দোলনে কমরেড মনিসিংহের নেতৃত্বে যোগ দিয়ে ছিলেন বলেই আমার মতো হতো দরিদ্রদের সরকার ঘর দিয়েছেন, সরকারী অনুদান পাচ্ছি। শুধু তাই নয় অনেক জ্ঞানীগুণীদের পদোধুলি পড়ে এই পাহাড়ে টিলার বাড়িতে। এতে আমরা ভীষণ খুশি ভাই-বোনেরা। তিনি বলেন, মায়ের বয়স শত ছাড়িয়েছে, আর বাবা লঙ্কেশ^র আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন ২০০০ সালে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, তারা তিন ভাই, দুই বোন। বড় ভাই লমিন হাজং থাকেন কুল্লাগড়া ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামে। ছোট ভাই সহদেব হাজং মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের তোড়াতে স্থায়ীভাবে সববাস করছেন। বোন মেনজুলি হাজং মানিকগঞ্জে ও ছোট বোন অঞ্জুলী হাজং থাকেন ঢাকায়। খুশি কবীর ম্যাডামের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে সে। সম্পাদনা : মাজহারুল ইসলাম
