
বরেন্দ্র অঞ্চলে কাজে আসছে না কৃষি আবহাওয়া প্রকল্প
ইউসুফ আলী সুমন, রাজশাহী : জলবায়ু, কৃষি আবহাওয়া, নদ-নদীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত উন্নতমানের পরিষেবা ও নির্ভরযোগ্য তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছাতে এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষি বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে সরকার। প্রকল্পটি দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে অবদান রাখার কথা থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনে অধিকতর ঝুঁকিতে থাকা বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকের কোন কাজেই আসছে না। এ অঞ্চলের ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড, স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র (রেইন গেজ মিটার) ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর। সচল বোর্ডগুলোতেও নিয়মিত তথ্য হাল-নাগাদ করা হয় না। যান্ত্রিক ত্রæটি এর জন্যে দায়ী বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামের বেশিরভাগ কৃষক লেখাপড়া জানেন না বা কম জানেন। কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ডে দেওয়া আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য চাষিরা পড়বেন কি করে এমন প্রশ্ন তাদের। আর প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি- প্রকল্পের কার্যক্রম কৃষকের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, কৃষির উন্নয়ন ও দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী এতে অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১৫ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং বিশ^ব্যাংক প্রকল্প ঋণ বাবদ সহায়তা করছে ১৯৭ কোটি ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমে কম্পোনেন্ট-সি এর তিনটি সাব-কম্পোনেন্ট রয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি (বামিস) পোর্টাল স্থাপন; প্রশিক্ষণ, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন; নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকরণ এবং তা বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। প্রকল্পের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, প্রকল্পের আওতায় কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক প্রায়োগিক গবেষণা, দক্ষ জনবল তৈরির জন্য দুটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক নতুন বিভাগ চালু করা; ১৬০টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন ও ১২টি অঞ্চলে কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এর মাধ্যমে কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি জেলার জন্য সপ্তাহে দুদিন, জাতীয় পর্যায়ে একদিন কৃষি আবহাওয়া বুলেটিন ও পরামর্শ তৈরি, সরবরাহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে এবং পরে করণীয় সম্পর্কে বিশেষ বুলেটিন প্রদান করা হয়। যা প্রকল্পের ওয়বেসাইট ও বামিস মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে পাওয়া যায়। এছাড়াও দেশের নির্দিষ্ট ৩০ হাজার কৃষক প্রতিনিধির তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের মোবাইলে এসএমএস, ভয়েস ম্যাসেজের মাধ্যমে জরুরি অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা হয় বলে দাবি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীর পবা, তানোর, মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা উপজোর ৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদে প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র ও কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ড এবং প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কিয়স্ক সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য প্রেরণ ও সংরক্ষণের জন্য ৯টি অফলাইন ইউপিএস, ৯টি প্রিন্টার, ২৭টি প্রিন্টার টোনার, ৯টি রাউটার, ১৫৫টি পেন ড্রাইভ ও ইন্টারনেট সংযোগসহ ১৫৫টি ট্যাব এবং জেলা কৃষি বিভাগে স্মার্ট এলইডি বের্ড স্থাপন; একটি ল্যাপটপ, স্ক্যানার, প্রিন্টার ও রাউটার সরবরাহ করা হয়। নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় উপজেলা এবং ইউনিয়নের ভিত্তিতে একই পরিমাণ যন্ত্রপাতি প্রদান করা হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটি ইউপি ভবনের ছাদে স্থাপন করা হয়েছিল স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। আর ইউপি ভবনের দর্শনীয় স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার বোর্ড। বোর্ডগুলো এনালগ। হাত দিয়ে ঘুরিয়ে এর প্রাত্যহিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এই বোর্ডের মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়ের পূর্বাভাস, আলোক ঘণ্টাসহ ১০টি বিষয়ে তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, আগে ও পরের তিন দিনের কৃষিভিত্তিক আবহাওয়ার নানা তথ্য এই বোর্ডে হালনাগাদ থাকার কথা থাকলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে সেটা কোনো দিনই সচল ছিল না।
নওগাঁর বক্তারপুর, বোয়ালিয়া, মহাদেবপুর সদর, খাজুর, হাতুড়, চাঁন্দাশসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের ২০-২৫টি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা গেছে, ইউপি ভবনের ছাদে ড্রামাকৃতির একটি যন্ত্র বসানো আছে, সঙ্গে রয়েছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। আর কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য তথ্য বোর্ড রয়েছে ভবনের নিচতলায়। কোথাও তথ্য বোর্ডে তথ্য পাওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও তথ্য বোর্ডের সংখ্যার ঘুঁটিও নেই। স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও সেসব যন্ত্র খোয়া গেছে। এদিকে, অনেক স্থানেই কৃষি অফিসে কিয়স্ক ব্যবহার হয় না, কর্মকর্তারা অনেকে জানেনও না। এছাড়া জেলা পর্যায়ে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে বেশিরভাগ কৃষক গ্রামের, তাহলে জেলা শহরের ডিজিটাল বোর্ড (এলইডি) কি কাজে আসবে সেটি নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেক কৃষক যেখানে লেখাপড়া জানেন না বা কম জানেন, তারা বোর্ডে দেওয়া তথ্য পড়বেন কি করে এমন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের। নওগাঁর বোয়ালিয়া ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস ও তিলোকপুর ইউনিয়নের আদম দূর্গাপুর গ্রামের মাসুদ রানা সাংবাদিকদের বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়ালে একটি আবহাওয়া বোর্ড টাঙানো আছে। কিন্তু তার কোন কার্যক্রম আমরা দেখি না। কোন কর্মকর্তাও আমাদের বলেনি আসলে বোর্ডের কাজটা কি। এছাড়া আবহাওয়া বিষয়ে কৃষি অফিস থেকেও কেউ অবগত করে না বলে দাবি তাদের। জেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের কৃষক মিলন, আশরাফুল ও আমজাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড আদৌ আছে কিনা তা অনেকেই জানেন না। এ বোর্ডের উপকার কি তাও অনেক কৃষক জানেন না। সরকার এত টাকা খরচ করে এমন একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলো, যা কৃষকের কোন কাজে লাগে না। একই কথা বলেন রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার শাহিনুর আলম, হুমায়ন কবিরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের আরও ৪০-৪৫ জন কৃষক।
নওগাঁ সদর উপজেলার বাচারীগ্রাম বøকের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বৃষ্টি পরিমাপক যন্ত্র রেইন গেজ মিটার। যা নিজেস্ব ডিভাইস থেকে অ্যাপসে বøুটুথ এর মাধ্যমে ৭ দিনের বৃষ্টির পরিমাপ পাওয়া যায়। বর্তমানে যন্ত্রটি অনেক দিন থেকে আর কাজ করছে না। এ যন্ত্রটিতে পাওয়ার ¯øাপাইয়ের যে সোলার প্যানেল থাকার কথা তা নেই। আগে হয়ত ছিল। এ বøকে যোগদানের পর থেকেই দেখছি না। এ বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই বলে দাবি করেন এই ডিপ্লোমা কৃষিবিদ । মহাদেবপুর উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের আলী দেওনা বøকের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. এজাদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ডের বিষয়ে আমার জানা নেই। এছাড়া ওই বোর্ড কখনো চালু করা হয়নি। দেওয়ালে লাগানো পর ওই অবস্থায় আছে। এ বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। আবহাওয়া অফিসে ফোন দিয়ে তথ্য নিয়ে কৃষকদের অবগত করা হয়। নওগাঁর বক্তারপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আব্দুল মতিন সাংবাদিকদের বলেন, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাসের বোর্ড থাকলেও কখনো আপডেট এবং কার্যক্রম করা হয়নি। এমনকি এ নিয়ে কখনো কোন সভায় আলোচনাও হয়নি।
বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি আবহাওয়া প্রকল্প কৃষকের কাজে না আসার বিষয়ে জানতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কর্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ততার কথা জানান। টেলিফোনে প্রকল্পটির পরিচালক (পিডি) ডক্টর মো. শাহ কামাল খান বলেন, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ডে তথ্য হালনাগাদের দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তাদের। এর জন্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে একাধিকবার পত্র প্রেরণ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
