ভারতের ভারসাম্যের বাজেটে নেই অসাম্যের উল্লেখ
জয়দীপ বিশ্বাস
দূষণ ছড়াচ্ছে এমন সব পুরনো সরকারি গাড়ি এবং এম্বুলেন্স পাল্টে ফেলা হবে। বাজেট পড়ার সময় এই লাইনটিতে এসে নির্মলা সীতারমণ বলতে চেয়েছিলেন ‘রিপ্লেস পলিউটিং ভিহকেল …’ কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেললেন ‘পোলিটিক্যাল ভিহকেল’! স্বভাবতই লোকসভা জুড়ে হাসির হররা তথন। হাসির আড়ালে অর্থমন্ত্রীও ঢেকে নিলেন তাঁর অপ্রতিভ চেহারা। গোটা ঘটনাটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। এমনতো কতই ঘটে!
কিন্তু এই আপাত নিরীহ ফরাসি ফপাঁতে কি কোথাও লুকিয়ে আছে দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির এক নিগূঢ় সত্য! দেশে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর অসাম্যের ত্র্যহস্পর্শ। কিন্তু নির্মলার পঞ্চম বাজেটের চৌত্রিশ পাতা বক্তৃতায় ক্রমবর্ধমান অসাম্যের কোনও উল্লেখ নেই। কেউ তর্ক করতেই পারেন। নেই কোথায়, আছে তো! অমৃতকাল ঘিরে যে সপ্ত ঋষির সমাবেশ ঘটিয়েছেন অর্থমন্ত্রী সেখানেই ঈশান কোণে ঝলমল করছে ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট। বিকাশ প্রক্রিয়ায় সবাইকে শামিল করাই এবারকার বাজেটের সাতটি প্রাথমিকতার অন্যতম এক। কিন্তু সবাইকে বিকাশের সহযাত্রী করতে গেলে তো সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হয়। সাত আট শতাংশে ঘোরাঘুরি করছে কর্মহীনতার হার। একানব্বই থেকে আজ পর্যন্ত এ সরকার সে সরকার সবাই মিলে কর্পোরেট ভারতের সুবিধা করে দিতে কসুর করেন নি। কিন্তু তাতে পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও হেলদোল হয় নি। ‘কাজ’-এর কাজ বিশেষ চোখে পড়েনি। তবে হ্যাঁ, স্বদেশি বিলিওনিয়ারদের সংখ্যা বেড়েছে বৈকি! অক্সফ্যামের সাড়া জাগানো সা¤প্রতিক সমীক্ষা আমাদের জানাচ্ছে যে একশ কোটি ডলার সম্পদের মালিক এমন ভারতীয়ের সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল কুল্লে ন’জন। আর এখন এই ধনকুবেরদের সংখ্যা হচ্ছে ১৬৬! গত পাঁচ বছরেই নতুন পঁয়ষট্টিজন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। তা কুবেররা তাঁদের বিষয়-আশয় নিয়ে থাকুন। এতে আমাদের কোনও হিংসে নেই। কিন্তু এরপরও যদি বলা হয় যে, আমাদের দেশের বিকাশ প্রক্রিয়াটি ইনক্লুসিভ, তাতে কিন্তু আমাদের ‘দুই খান’ কথা থাকবেই।
আসলে যে-উৎপাদন সম্পর্কের মাধ্যমে বিকাশ হচ্ছে এতে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়বেই। এটা একটা মতাদর্শগত সংকট। কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্র বেছে নেবে তা হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই চয়নে ভোটের রাজনীতি নিয়ামক ভূমিকায় থেকে যায়। তাই রাজনৈতিক চিন্তায় বড়সড় পরিবর্তন না এলে এই অসাম্য ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির কোনও ইশারা আছে বলে তো মনে হয় না। অর্থমন্ত্রীর অনিচ্ছাকৃত শব্দবদল সেই অদৃশ্য সম্ভাবনার রূপক হিসেবে কাজ করেছে।
আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান মেয়াদের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে কিন্তু একটি দক্ষিণপন্থী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নির্মলা কোনও ভুলই করেন নি। গত বাজেটে প্রস্তাবিত রাজকোষ ঘাটতি ছিল ৬.৪ শতাংশ। বছরের শেষে রিভাইজড এস্টিমেটেও তা পাল্টায় নি। এটা অবশ্যই সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলার পরিচয়। আগামী অর্থবছরের জন্য রাজকোষ ঘাটতি কমিয়ে ধরা হয়েছে ৫.৯ শতাংশ। বছর দুয়েক পর এই ঘাটতি সাড়ে চার শতাংশে নিয়ে আসার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ত পূরণ হবার সম্ভাবনা অবশ্যই এতে বেড়ে গেল। আর হবে নাই বা কেন? রাজস্ব ঘাটতি যে নেমে আসছে আরও দ্রæত গতিতে!
রাজস্ব ঘাটতি হ্রাস পাওয়ার বড় কারণটি হচ্ছে এই যে, আমরা আমাদের পরিবারে যেমনটা করি ঠিক তেমনি আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যয় করছে সরকার। ফলে মূলধনী খাতে সরকারি লগ্নির বহর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। এই বাজেটে মোট দশ লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাব রয়েছে কেইনসিও ধাঁচে সরকারি বিনিয়োগে যা গত বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। রেলে রীতিমতো রেকর্ড করে লগ্নি ধরা হয়েছে ২.৪ লক্ষ কোটি টাকা।
অর্থাৎ রাজস্ব খাতে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে মূলধনী খাতে তা বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলেই, একটু নজর করলেই ধরা পড়বে, মোট বাজেট বহর কিন্তু তেমন কিছু বাড়ে নি। চলতি অর্থবছরে রিভাইজড এস্টিমেট মতে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয়বরাদ্দ হচ্ছে ৪১.৮৭ লক্ষ কোটি টাকা। আর এবারের বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ব্যয়বরাদ্দ হচ্ছে ৪৫ লক্ষ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে তাহলে এক বছরে সরকারি ব্যয়ে বৃদ্ধির হার দাঁড়াচ্ছে ৭.৫৪ শতাংশ। দ্রব্যমূল্যের যেমন ঊর্ধ্বগতি তা মনে রাখলে এবং হিসেবে ধরলে কার্যত এক দেড় শতাংশই খরচ বাড়ছে। অথচ আগামী বছরের জন্য নর্থ বøক বিকাশের অনুমিত হার রেখেছে সাড়ে ছয় শতাংশ মতো। মোদ্দা কথা, উন্নয়নের নামে যতটা খরচ হচ্ছে বলে মনে হয়, কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখলে ততটা যে নয় তা বোঝা যায়।
আয়করের বেলায় বেশ কিছু ভালো খবর রয়েছে মধ্যবিত্তের জন্য। অবশ্য সেখানেও কিঞ্চিৎ ধোঁয়াশা আছে। যেমন, বলা হচ্ছে পনের লক্ষ টাকা যাঁদের বার্ষিক আয় তাদের পকেটে ঢুকে যাবে করকরে সাড়ে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা। কিন্তু যেহেতু আমরা জানিনা যে, আগামী অর্থবছরে কত জন করদাতা নতুন করে ব্যবস্থায় ঢুকবেন, তাই কারা কতটা সুবিধা পাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার নয়। যে কোনও কর বিশেষজ্ঞ কিন্তু বলবেন যে, এখনও আয়করের পুরনো কাঠামোয় থেকে গেলেই লাভ। তা সেখানে তো কোনও পরিবর্তন করা হয় নি। তবে হ্যাঁ, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর মিলিয়ে এবারকার কর-প্রস্তাবে কোষাগারের ক্ষতি হয়েছে পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকা।
পরিবেশ বান্ধব চাষবাস, কার্বন কমিয়ে আনা, অমলিন জ্বালানি ও শক্তির আয়োজন, পরিকাঠামো ও পুঁজিতে জোর এবং ঝকঝকে হিসেবখাতা। সীতা শেষ পরীক্ষাটা কিন্তু দারুণ দিয়েছেন।
তবে ওই চাকরি বাকরি, দু’বেলা পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়া, অসাম্য আর বাজারের চড়া দাম? ওসবের কথা বলে লাভ নেই। বাজার অর্থনীতির সিলেবাসেই যা নেই তা থেকে প্রশ্ন করলে কী করে জবাব দেবেন জেএনইউ-এর দুঁদে প্রাক্তনী আমাদের ‘মধ্যবিত্ত’ অর্থমন্ত্রী!
লেখক: আসামের চাহার কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক