প্রমিত বাঙলায় ‘স’-এর জন্য কোনো বর্ণ নেই
বেগম জাহান আরা
বাঙলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের পরিচিতির ভাষা। জীবন বিকাশের ভাষা। রাষ্ট্রীয় ভাষা। পৃথিবীর আধুনিকতমো ভাষার একটি হলো বাঙলা। বলা হয়, পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাঙলা। আমরা গর্বিত বাঙলা ভাষার উত্তরাধিকার হয়ে। কিন্তু এই অহংবোধের সাথে সাথে আমাদের দায়িত্বও আছে বাঙলা ভাষাকে আধুনিক বিশ্বে কার্যকর ভাষা হিসেবে উপস্থাপন করার। সে অনেক কাজ। যেমন; বাঙলা বানান সংস্কার একটা।
বাঙলা বানানে সমস্যার চেয়ে মতান্তরের ঝড় বেশি। পোকা বাছার মতো একটা একটা করে সমস্যার সমাধানে সবাই মিলে কাজ করার চেয়ে মাথা ঘামানো বেশি হয় মতান্তরের বিষয় নিয়ে। ফলে সমস্যাগুলো/ নিয়ে আমরা ঘুরপাক খাই। সমাধানের দিকেই যেতে পারি না। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বৈয়াকরণেরা বলেছেন, বাঙলায় দীর্ঘ স্বর নেই। বাঙলা একাডেমিও নিমরাজি কথাটায়। তবে একাডেমি একটা ‘কিন্তু’ রেখে দিয়েছে কয়েকটা বানানের বেলায়। তো অনেকেই এখন বলেন, বাঙলা একাডেমির বিধান আমরা মানি না। বিশেষ করে ওপার বাঙলার কিছু আলোকিত মানুষ বলেন যে, ‘রেফ-এর পর দিত্ব ব্যঞ্জন হবে না, এই সিদ্ধান্তও ভুল’। মানে, কোলকাতা বানান সংস্কার সমিতির সিদ্ধান্তও ভুল। এই ভাবে পায়ে পায়ে ল্যাং মারলে মানুষ এগোতে পারে?
বাঙলা বানানে তিন ‘স, শ, ষ’ নিয়ে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি শতো শতো বছর যাবত। কারণ আমাদের উচ্চারণে তিন স-ই প্রায় একরকম ভাবে উচ্চারিত হয়। যেমন; সকাল, সন্ধে, সময়, সামনে, শহর, শকুন, শাড়ি, শেকল, ষাঁড়, ষোলো, ষড়, ষন্ডা, এই বারোটা শব্দেরই প্রথমে আছে স/শ/ষ। কিন্তু উচ্চারণ হচ্ছে একটা ‘শ’। শব্দের মাঝে বা অন্তেও একই অবস্থা। যেমন; বাসা, আসা, আসল, বসা, আবাস, সাবাস, সাহস, এসেছিস; শশা, মশা, আশা, দশা, তামাশা, হতাশা, দুরাশা, প্রত্যাশা; আষাঢ়, পাষান, কষাই, নিকষ, বিষ, ভাষা, মহিষ, ইত্যাদি শব্দের মধ্য ও অন্তের স / শ / ষ-এর উচ্চারণেও একই ‘শ’ পাওয়া যায়। কোলকাতার বানান সংস্কার পুস্তিকায় বলা হয়েছে, তিন শ-এর মধ্যে একটি বা দুটি বর্জন করলে বাঙলা উচ্চারণে কোনো বাধা হয় না। এই কথাটা মতান্তরের আর একটা উতস।
সমস্যা হলো, কোন বিশেষ একটি বা কোন বিশেষ দুটি ‘শ’ বর্জন করা যেতে পারে, তার কোনো দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি। গিটটু একটা দিয়ে ছেড়ে দিলে সেটা খুলবে কে? এই কথাটার মধ্যে একটু দায়হীনতার ব্যাপারও আছে। কারণ স-দিয়ে লেখা কোনও কোনও যুক্তাক্ষরে ‘স’-এর ‘ঝ’ উচ্চারণ পাওয়া যায়, যেমন; স্তর, স্তব, স্থান, স্নেহ, শ্রাবন, শ্লাঘা, শ্লিল, শ্রবন, ইত্যাদি শব্দে স্পষ্ট ‘দন্ত স’-এর উচ্চারণ পাই আমরা। কিন্তু ‘ষ’ দিয়ে যে কয়টা যুক্তাক্ষর আছে তার কোনোটাতেই দন্ত স-এর উচ্চারণ আসে না। অন্যদিকে’ষ’ দিয়ে শুরু হয় এমন বাঙলা শব্দও অভিধানে মাত্র কয়টা। বাকিগুলো বুতপত্তিজাত শব্দ। আর ‘ষ’ মধ্যে বা অন্তে থাকেল তার উচ্চারণ শ-এর মতোই হয়। ‘ষ’-এর উচ্চারণ কখনও ‘স’বা ‘ঝ’-এর মতো হয় না। এক্ষেত্রে যদি ধরে নেয়া যায়, ‘ষ’-কেই বাদ দেয়া যায় সহজে, তাহলে কেমন হয়? এই রকম একটা সিদ্ধান্ত পেলে আমাদের জন্যে ভালো হতো। তা যখন পাওয়া যায়নি, তখন আমাদের সমস্যা আমাদেরই দুর করতে হবে।
বাঙলা একাডেমির ব্যাবহারিক অভিধানে মূর্ধা ‘ষ’-এর উচ্চারন বোঝানোর জন্য তালব্য শ-ই ব্যাবহার করা হয়। মানেটা কি এই দাঁড়ায় না যে, ‘ষ’-এর উচ্চারণ আর আমাদের মুখে নেই। বৈয়াকরনদের মতে, ‘ণ, ষ’ ধ্বনি প্রাচীন বাঙলাতেই লুপ্ত হয়েছে। এটাকেই স্বীকৃত সত্য বলে মেনে যায় নাকি? এই দুইটি ধ্বনি আমাদের উচ্চারণে ছিলোও না কোনোকালে।
অন্যদিকে বাঙলা একাডেমির প্রমিত বাঙলা বানানের নিয়মে বলা হয়েছে, ততসম শব্দের বানান তথৈবচ রাখতে হবে। তার মানে ‘ষ’ বাঙলা বানানে থাকবে। মুখে থাক বা না থাক, বানানে তাকে চাই। এই বিপরীতমুখী চিন্তা এবং বানানে তা শেখানোর অভিধানলগ্ন বিধিই সমস্যাকে লালন করছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সাহস কেউ দেখাচ্ছি না। মানে সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কোন দিকে যাবো, সে কথাটাও কেউ মুখে আনলেন না। তাই কোলকাতার বানান সংস্কার বিধি বা পরামর্শ অনুযায়ী (যদিও নির্দিষ্ট করে বলা নেই, তবে শব্দের উদাহরন দেখে মনে হয়), ‘ষ’-কে বাদ দেয়াই যায়। এই একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোকে বিচার করে এবং বাঙলা ভাষার চরিত্র ও বৈশিষ্ট দেখে মনে হয় ‘ষ’-কে বাঙলা বর্ণমালা থেকে বিদায় দিতে হবে। আর কতো? হলো তো অনেক। আমরা তো বানান মুখস্ত করেছি, করতে হবে তাই। এখনকার প্রজন্ম গরমিল বা গোঁজামিল দেখলে প্রশ্ন করে। পছন্দ না হলে বর্ণ বাদ দিতে বলে। স্পষ্টই বলে, তিনটে ‘শ’-এর দরকার নেই। এই সহজ সাবলীল দাবিটাই তুলতে পারেন না সচেতন ভাষীরা।
তবু বাকি থাকে কাজ। সেটা হলো, ‘দন্ত স’-কে ‘ঝ’-এর মতো করে উচ্চারণের একটা সিদ্ধান্ত নেয়া, এবং ‘শ’ দিয়ে ‘শ’-এর উচ্চারণ করা। তাহলে ‘সকাল সন্ধে’ বানান ‘শকাল শন্ধে’ লেখতে হয়। এমন বানান তো অনেক দিন থেকেই বেশ কিছু শিক্ষিত সচেতন ভাষী লেখছেনও। তাহলে সেটাই স্বীকার করে নিই আমরা? তাতেও সন্তুষ্ট হচ্ছি না। এটা তো ঠিক, উচ্চারণানুগ বানানের জন্যই একদা বানান সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো। সেই স্পিরিট কেনো নেই আমাদের? একটা পথ বা মত তো বেছে নিতেই হবে। ‘হযবরল’ আর কতোদিন?
এই ‘হযবরল’ জনিত সিদ্ধানহীনতা আমাদেরকে অন্য ভ্রমের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আজকাল ‘শ্রাবন, শ্রেষ্ঠ, শ্রিলঙ্কা, শ্লীল, অশ্লীল, শ্লাঘা’, ইত্যাদি শব্দের উচ্চারণে গায়ের জোরে ‘শ’ কে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন। ফলে আমাদের মুখে এতোকাল যে শব্দগুলোর উচ্চারণ ছিলো, ‘স্রাবন স্রেষ্ঠ, স্রিলঙ্কা, ¯িøল, অ¯িøল, ¯øাঘা (srabon, sreshtho, srilonka, slil, oslil, slagha),তা হয়ে যাচ্ছে, , , shrabon, shreshtho shrilongka, shill, oshlil, shlagha, তাতে কিন্তু উচ্চারণ অস্পস্ট হয়ে যাচ্ছে। হচ্ছে, না ঘরকা, না ঘাটকা। তাঁদের ধারনা, যেহেতু বানানটা লেখা আছে ‘শ’-দিয়ে, তাই ‘শ’-এর উচ্চারণই করতে হবে। এটাও তো মেনে নিচ্ছি না আমরা। তাহলে উপায় কি? এভাবেই চলবে বাঙলা উচ্চারণের ‘হযবরল’?
এখানে হলো উলটো ব্যাপার। লিপি দেখে উচ্চারণ করা হচ্ছে। সেই কাজটা আরো কঠিন। যে কারণে চর্যাপদ-এর পাঠ নিয়ে সমস্যা কাটে না। কারন তার উচ্চারণ পাওয়া আর সম্ভব নয়। তাই লিপি দেখেই উচ্চারণের পাঠ নির্ধারন করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে গরমিল লেগেই থাকার কথা এবং আছে। নরওয়ের পন্ডিত পারকাভার্নের বইতে রোমান হরফে চর্যাপদের যে পাঠ পাওয়া যায়, তার সাথে বাঙলা বইয়ে লেখা উচ্চারণের কিছু গরমিল দেখা যায়। এবং সেটাই স্বাভাবিক।
অনেক শিক্ষিত পদবীধারী মানুষকেও দেখেছি, কেউ কেউ ‘ছ’ দিয়ে ‘ঝ’-এর উচ্চারণ বোঝাতে চান। যেমন; ইছলাম, ছালাম, নাছির, ইত্যাদি বানান। আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণে যেহেতু ‘ছ’-এর উচ্চারণ ‘দন্ত স’-এর মতো, তাই তাঁদের ধারনা ‘ছ’ লেখে ‘ঝ’-এর কাজ সারা যায়। কিন্তু এই বানান প্রমিত বাঙলায় চলে না। ‘ছ’ হলো ঘৃষ্ট বা ঘর্ষণজাত ধ্বনি। আর দন্ত-স হলো শিশ ধ্বনি। শাস্ত্রমতে দুটো ধনির উচ্চারণের স্থান এবং উচ্চারণ রীতি একেবারে আলাদা। এই বিষয়গুলো বাঙলা ব্যাকরণে থাকার কথা। বর্ণের পাঠে প্রতিটি বর্ণের শাস্ত্রীয় উচ্চারণ প্রাথমিক শিক্ষা পর্বেই বিশ্লেষণ করে শেখানো আবশ্যিক।
আবার কিছু কিছু বানানে পাশাপাশি দুই ‘স, শ’ থাকলেও তার উচ্চারণে পাই একটা ‘শ’। যেমন; ‘প্রশাসন, অশেষ, বিশেষ, শস্য’, এই শব্দগুলোর সব ‘শ’-ই আমাদের উচ্চারণে ‘শ’ হিসেবে উচ্চারিত হয়। এখানেও প্রজন্মের প্রশ্ন, তাহলে আর দুইটা ‘শ’-এর প্রয়োজন কি? তাদের কথার উত্তর কেউ দেয় না। কিন্তু গা বাঁচিয়ে কোথায় পালাবো আমরা? তিন ‘স’ নিয়ে আমাদের কালে আমরা হাবুডুবু খেয়েছি। আমাদের প্রথম প্রজন্মও খেয়েছে। তৃতীয় প্রজন্মের এরা একুশ শতকের মানুষ। চোখ বুঁজে কিছু মুখস্ত করার পক্ষে না। জেনে বুঝে যাচাই করে শিখতে চায়। তাই তারা প্রশ্ন তুলেছে তিন ‘স/শ/ষ’ নিয়ে। মুখস্ত বিদ্যা নিয়ে জীবন কাটানোর পক্ষে বয়সী এই আমাদের প্রজন্ম, এখন ওদের প্রতিপক্ষ হয়েছি। সংকোচে থাকি। ওদের কথার উত্তর দিতে পারি না।
সংস্কৃত তথা ততসম শব্দ ‘শ্মশান, স্মরন, স্মৃতি’ (smoshan, smoron, smriti)) ইত্যাদি শব্দে আমাদের উচারণ কখনও ‘শ’ কখনও ‘স’-এর মতো। মানে, আমরা বলি, ‘শশান, শরন, স্রিতি’। বাঙলায় শব্দের আদিতে ‘শ+ম’ যুক্ত হলেও তার উচ্চারণ হয়ে যাচ্ছে শুধু তালব্য ‘শ’। একই ভাবে, আদিতে ‘স+ম’ যুক্ত হয়েও উচ্চারণ হচ্ছে শুধু তালব্য ‘শ’। আবার কখনও ‘স+ম+ঋ-কার’ যুক্ত হলে ‘স-এর’ উচ্চারণ থেকে যাচ্ছে ‘স’। এই সব ঝামেলার সমাধান মহাপন্ডিত পানিনিও মিটিয়ে ফেলতে পারেন নি। আমরা তো কোন ছার? কিন্তু প্রজুক্তি আর বিজ্ঞান এখন যুক্তির আলোকে পানিনির চেয়ে বেশি ত্রæটিহীন কাজ করতে পারে। একুশ শতকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দুরন্ত দাপটে অনেক কিছুই এখন ব্যাখ্যা করা যায়, যা আগে যেতো না। তাহলে বিজ্ঞানের সেই বিদ্যাটা আমরা কাজে লাগাবো না কেনো?
আমরা যে কিছু পরিবর্তন করিনি তা তো নয়। সংস্কৃতে যাsmoshan, smoron বাঙলায় তা Ôshoshan, shoronÕ|। তার মানে আমরা বাঙলা উচ্চারন করি। আমাদের বাঙলা জিবে, মানে স্বভাবে, এটাই আছে সেই কোন কাল থেকে। কিন্তু তবু বানানে লেখা যাবে না। অনেকের ধারণা, বানানে পরিবর্তন আনলে শব্দের অর্থ বদলে যাবে। আসলে শব্দের প্রকৃত অর্থ তো পাওয়া যায় বাক্যে প্রয়োগের ওপর। নইলে সমধ্বনিজ শব্দের ব্যবহার সম্ভব হতো না। এই এলোমেলো বিষয়গুলো ঠিক করা যায় অবশ্যই। সেটাই করতে চাই আমরা সবার সহযোগিতা এবং আলোচনার মাধ্যমে।
আরও কিছু শব্দের উচ্চারণ নয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক। যাঁরা জন্ম থেকে ‘শ্রাবন’-কে `srabon’ উচ্চারন করে এসেছেন, এবং অভ্যেস করেছেন তাঁরা পেরে যাচ্ছেন। আর যাঁরা ‘শ্রাবন’-কে ‘ংৎধনড়হ’ শুনে এবং বলে এসেছেন (যেমন আমরা), তাঁদের আয়ত্বে আসছে না সেই উচ্চারণ। আমরা তো ছোটো বেলায় ঐ শব্দগুলোর উচ্চারণ করেছি, ‘স্রেষ্ঠ, স্রিলংকা, স্রিগাল, ¯িøল, অ¯িøল, ¯øাঘা’। এবং এখনও তাই করি। হঠাত নতুন এই প্রবনতার এবং তা চর্চার কোনোই প্রয়োজন নেই বাঙলা ভাষায়। ভাষা তো বহতা নদীর মতো। সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তার মুখ পেছনে ফেরাতে গেলে বিভ্রাট বাড়বেই।
একটা নিয়ম আছে, সেটা এখানে বলা যেতে পারে। যেমন; ‘শ/স’-এর সাথে ‘র, ল, ন’ যুক্ত হলে তার উচ্চারণ ‘স’ হয়ে যায়। দৃষ্টান্ত, ‘শ্রেষ্ঠ, শ্রান্ত, শ্লেষ, শ্লীল, প্রশ্ন, স্নেহ’ ইত্যাদি শব্দের ‘স/শ’-এর উচ্চারণ ‘স’ হয়ে গেছে আমাদের উচ্চারণে। এমন উচ্চারণের কারণ ব্যাখ্যা করাও যায়। বাক প্রত্যঙ্গের মধ্যে ‘জিব’ সবচেয়ে বেশি কার্যকরএবং উত্তম মডিউলেটর। স্পষ্ট বোঝা যায়, ‘র, ল, ন’ আশ্রিত ধ্বনি হিশেবে আশ্রয়ী ধ্বনি ‘স/শ’-কে কাছে টেনে আনে। সেটাই সহজ হয় জিবের কাছে। কতকটা সহজাতও বটে জিবের জন্য। বাঙলা একাডেমির ব্যাকরণে (২০১২) এর সমর্থন পাওয়া যায়।
হিন্দি মারাঠি আসামি, উড়িয়া ভাষাতে ‘ভাষা পরিকল্পনা’ করে তারা এই নিয়ম করে নিয়েছে যে, দন্ত ‘স’-এর উচ্চারণ ‘শ’ হবে না। আর ‘শ’-এর উচ্চারণ দন্ত ‘স’-এর মতো হবে না। আমরা সেটা করতে পারিনি। গায়ের জোরে অশুদ্ধ উচ্চারণকে শুদ্ধ প্রমান করার জন্য নিজেরাই একটা আপোস রফা করেছি নিজেদের সাথে। নিয়মও তৈরি করা হয়েছে। সেটা হলো ‘শ’-এর সাথে ‘র/ল/ন’ যুক্ত হলে ‘শ’-এর উচ্চারণও হবে দন্ত ‘স’ বা ‘ঝ’-এর মতো (শ্রাবন, শশ্রæ, সুশ্রি। আর ত-বর্গিয় বর্ণের (ত, থ)সাথে যুক্ত থাকলে (যেমন, স্তম্ভ, স্থান, স্নান) এবং ‘স্ক স্ফ’ যদি শব্দের আদিতে থাকে তাহলে সেখানে দন্ত ‘স’-এর উচ্চারন হবে ‘ঝ’-এর মতো। কিন্তু শব্দের মধ্যে ‘স্ক, স্ফ’ থাকলে (আস্কারা, আস্ফালন) সেটার উচ্চারণ হয়ে যাবে ‘শ’-এর মতো। এখন এই সব নিয়মকে মনে হয় দারুন গোঁজামিল। কিন্তু এক সময় আমিও সায় দিয়েছি। ভাবতেই নিজেকে অপরাধী লাগে। এখন বুঝতে পারছি সেটা কতো বড়ো সর্বনাশা ভুল। আমাদের প্রয়োজন একটা জাতীয় সিদ্ধান্ত। মানে, দুই ‘স, শ’-কে দুই ভাবে উচ্চারন করতে হবে। তাহলে উচ্চারনানুগ হবে বানানও। মুর্ধা ষ-এর কথা আর বলছি না। আমি বর্জন করেছি অনেক আগেই। দায় নিয়েই করেছি। ভাষা বিজ্ঞানের যুক্তিতেই করেছি। আর তাতে সমর্থন আছে এই উপমহাদেশের পন্ডিত বৈয়াকরন ড. সুনীতি বাবু এবং ড. শহীদুল্লাহ সাহেবের। তাঁরা বলেছেন, মূর্ধা ‘ণ’ আর মূর্ধা ‘ষ’ প্রাচীন বাঙলাতেই লুপ্ত হয়েছে। আধুনিক বাঙলায় তারা অজ্ঞাত। কেমন করে ভুলি কথাগুলো? কিন্তু তাঁদের লেখায় বর্ণ দুটি কেউ বাদ দেন নি। পন্ডিতদের দ্বিচারনে সমস্যা হয়েছে শক্ত। ফলে উচ্চারনের স্বভাব আর বানানের অভ্যেস এক হচ্ছে না। তবু সমাধান তো করতেই হবে।
স্বীকার্য যে, এই সংশোধনের সিদ্ধান্তে অনেক কাজ এসে পড়বে। অভিধানে শুধু দন্ত ‘স’-এর পৃষ্ঠাগুলোতেই আমূল সংস্কার প্রয়োজন হবে। তবে তার আগে জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন অনিবার্য। বহুবার বহু ফোরামে ভাষানীতির কথা বলা হচ্ছে। এই কাজটা না হলে আমাদের বানান এবং উচ্চারণের সমস্যা কাটবে না। তাই আমাদেরকে কথাটা বলেই যেতে হবে।
আগেও বলেছি, গোঁজামিল আর দিতে চাই না। আমরা যদি প্রমিত বাঙলা উচ্চারণের মতো বাঙলা বানান লেখতে চাই, তাতেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখনই দুর হয়ে যাবে স্বভাবজ উচ্চারন আর অভ্যেসজাত বানানের অসামঞ্জস্যতা। আসলে আমরা তো প্রমিত বাঙলা বানান লেখার কোনো চেষ্টাই করিনি কোনোদিন। সেই ভুলের জের আর টানতে চাই না। বাঙলা বানান হোক বাঙলার মতো। এটাও মনে রাখতে হবে, এই কাজ একদিনের নয়। প্রায় সোয়া দুইশো বছরের ভুল তো সহজে মুছে ফেলা যাবে না। প্রথমে দরকার বিষয়টা বোঝা। হিসেবের মধ্যে আনা। আলোচনার জন্য বসা। বলতে চাই, বাঙলায় দুই ‘স, শ’-এর ব্যাবহার বিধি ঠিক করে নিতে হবে।
সবচেয়ে বড়ো কথা, শুধু দন্ত ‘স’ দিয়ে বাঙলা কোনো শব্দ শুরু হয় না। মানে বাঙলা শব্দের আদিতে ‘স’-দিয়ে কোনো শব্দই নেই। বিদেশি শব্দ লেখার সময় লাগে দন্ত-স। যেমন, সফর মাস, সালাম, সাহরি, স্টাডি, স্টেডিয়াম, স্টার, ইত্যাদি। বাঙলায় ব্যবহৃত ততসম শব্দে যুক্ত অক্ষর দিয়ে শুরু আছে কিছু শব্দ, যেমন; স্তুপ, স্থান, স্খলন, স্পন্দন, স্তর, স্তিমিত, ইত্যাদি, আবার, আস্ত, মস্ত, সাস্থ, পস্তানো, ইত্যাদি শব্দে দন্ত ‘স ‘-এর উচ্চারন ‘ঝ’-এর মতো।
রবীন্দ্রনাথ একদা বাঙলায় বিদেশি শব্দের উচ্চারনানুগ বানান লেখার জন্য নতুন বর্ণ আমদানী বা সৃষ্টির কথা বলেছিলেন। ড. সুনীতিবাবুকেই বলেছিলেন কাজটা করতে। তিনি সাহস করেননি মনে হয়। যদিও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সমিতি স্বরধ্বনি ‘অ্যা’-র প্রতিক তথা বর্ণ আবিস্কার করে পথ তৈরি করে দিয়েছিলো। আমরা সে পথে হাঁটতে সাহস করলাম না। অথচ প্রয়োজনটা কিন্তু ফুরোয়নি এখনও।
শুধু নতুন বর্ন আবিষ্কার করা নয়, কিছু বর্ন বর্জনের কথাও ভাবেছেন আমাদের দেশের ভাষাবিজ্ঞানিরা। একুশ শতকে আমাদের কি আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা সাজে?
লেখক : ভাষাবিজ্ঞানী ও কথা সাহিত্যিক।