গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে নীরব বিপ্লব, আমদানি করতে হয় ২০ হাজার টন
মতিনুজ্জামান মিটু: চলমান নীরব বিপ্লবে বর্তমানে দেশে উৎপাদন হচ্ছে বছরে ১৫ হাজার টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট(বারি)’র চট্টগ্রামের হাটহাজারির আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, টমেটো শীতকালীন সবজি হলেও কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এবং বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন উদ্ভাবনে এটি এখন গ্রীষ্মকালেও ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। মে থেকে জুলাই মাসে লাগানো জাতের টমেটো শীতের আগ পর্যন্ত সময়েও বাজারে পাওয়া যায়। ভারত থেকে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আমদানি হলেও বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের সহায়তায় দেশজুড়ে বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড জাতের টমেটো কৃষক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। টমেটো চাষে কৃষকের সফলতার গল্পও জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এযাবত ৩২ টি জাতের টমোটো উদ্ভাবন করেছে। যার মধ্যে ১১টি হাইব্রিড জাত রয়েছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাত জাতের মধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, হাইব্রিড টমেটো-৮, হাইব্রিড টমেটো-১০ ও হাইব্রিড টমেটো-১১ দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এরমধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ রয়েছে সবার ওপরে। বিগত কয়েক বছর থেকে মাঠ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে এসব জাতের বিস্তারও হয়েছে। কৃষকও চাষাবাদ করে লাভের মুখ দেখছেন।
বিভিন্ন সুত্রের বরাতে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জামাল উদ্দিন আরও জানান, টমেটো একটি পুষ্টিকর সবজি। ইউরোপে টমেটোর গুণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘টমেটো যদি লাল হয়, চিকিৎসকের মুখ হয় নীল।’ নিয়মিত টমেটো খেলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার হয় না।
বারি সূত্র মতে, টমেটোতে রয়েছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’সহ অনেক দরকারি পুষ্টি উপাদান। ইয়ুথ হেলথ ম্যাগ ও টাইমস অব ইন্ডিয়া তথ্য সূত্রে, টমেটোতে রয়েছে বয়স প্রতিরোধী বিশেষ প্রভাব। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন প্রোস্টেট, কলোরেকটাল বা পেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমিয়ে দেয়। শরীরের ত্বক কুঁচকে যাওয়া, ভাঁজ পড়া বা বলিরেখা পড়া দূর করতে পারে। টমেটো হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। টমেটোর মধ্যে থাকা ভিটামিন ‘বি’ ও পটাশিয়াম রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। চোখের দৃষ্টি উন্নত করতে টমেটোর ভূমিকা অপরিসীম। শিশুদের ডায়েটে টমেটো রাখতে পারলে উপকার মেলে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার এরমতে, দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বাড়ানো গেলে কৃষকেরা যেমন লাভবান হবেন একই সঙ্গে টমেটো আর আমদানি করার দরকার হবেনা। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ হচ্ছে। চলতি বছরে বারি উৎপাদিত হাইব্রিড টমেটোর বীজ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে এবং আগামীতেও বারি’র পক্ষ থেকে কৃষকদেরকে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ দেওয়া হবে। আশা করা যায়; দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে দেশ টমেটো রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা ও যশোরসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার চাষিরা গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। উৎপাদিত টমেটো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ভালও দাম পাওয়ায় কৃষকরা খুশি। এতে সারা দেশে বাড়ছে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ।
কৃষি বিশেষজ্ঞদেরমতে, গ্রীষ্মকালীন উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের বারি টমেটো চাষের খুবই সম্ভাবনাময় জেলা সাতক্ষীরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ৭১২.৫০ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো চাষ হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন এর মতে, উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ খুবই লাভজনক একটি ফসল। তবে এটি উৎপাদন খরচের পরিমাণও অনেক বেশি। তার পরও হেক্টরে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। সাতক্ষীরা জেলা কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান এরমতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতীয় টমেটো আমদানি বন্ধ থাকায় দামও ভাল পাওয়া যায়। এসময় প্রতি কেজি গ্রীষ্মকালীন টমেটো ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়। সাতক্ষীরা ছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার, যশোর, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন উপজেলায় এর বিপুল সাড়া পড়ে।
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ খুলনা দৌলতপুরে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনর রশিদের তথ্যমতে, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় বর্তমানে বারি হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ এক হাজার বিঘা ছাড়িয়েছে যা ২০১৮ সালে ২৫ বিঘা ছিল। এক বিঘা জমিতে ‘গ্রীষ্মকালীন টমেটো’ চাষ করতে খরচ হয় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ফসল আসে তিন-চার লাখ টাকার। কখনো কখনো পাঁচ লাখও ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।
দেশের চাহিদার আলোকে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়াতে ‘বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর অভিযোজন পরীক্ষা, উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কমিউনিটিভিত্তিক পাইলট প্রোডাকশন কর্মসূচি’ শীর্ষক সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারির তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি চলমান রয়েছে। একর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন জেলার ৩৩টি উপজেলায় একর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ঘটছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে আগ্রহী করে তুলতে প্রকল্প থেকে নিয়মিত হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, উপকরণ সহায়তা, মাঠ দিবস ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
বারির সিনিয়র বিজ্ঞানী এবং কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. ফারুক হোসেন এর মতে, গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের ব্যবস্থাপনা শীতকালীন টমেটো চাষের ব্যবস্থাপনা থেকে আলাদা ধরণের। দুটো পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো যায়। একটি হলো পলিশেড দিয়ে অপরটি হলো মাটিতে পলিথিনের মালচিং বিছিয়ে। শেষের পদ্ধতি খরচ সাশ্রয়ী। আর্লি উইন্টারে এটমেটো পাওয়া যাবে, দামও বেশি পাবে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো গেলে পতিত জমিও চাষের আওতায় নিয়ে আসা সহজ হবে।