
আমাদের রপ্তানি খাত এবং একটি উপেক্ষিত খবর

কাকন রেজা
নি¤œআয়ের চাকুরে একজন সামাজিক মাধ্যমে লিখলেন, ‘গরিবের প্রোটিনের উৎস ছিলো ডিম, সেটাও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে’। আমি অর্থনীতি ভালো বুঝি না, কিন্তু বাজারে গেলে অর্থের উপর চাপটা বুঝি। ব্যয়ের বাড়তি চাপ মানুষকে এখন অর্থনীতি বুঝতে বাধ্য করছে। মানুষ আমাদের রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় বিষয়ে আলাপ করছে পাড়ার চায়ের দোকানে। অর্থপাচার, ব্যাংক লোপাট এসব ব্যাপারও উঠে আসছে সে আলোচনায়। উঠে আসছে ডলার সংকটের কথা। উঠে আসছে রেমিটেন্স এবং পোশাক রপ্তানি যে আমাদের রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধানতম উৎস সে আলাপ। চায়ের দোকানের এসব আলাপের অনেকটাই আমাদের গণমাধ্যমগুলো এবং বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় উঠে আসছে না। কিন্তু উঠে আসা প্রয়োজন নয় শুধু জরুরি ছিলো। এক অর্থে বলা যায়, আমাদের সাধারণ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন সঠিকভাবে ঘটছে না গণমাধ্যমে ও বুদ্ধিজীবীদের চিন্তায়। এমনি একটি উপেক্ষিত খবর বা আলাপের কথা নিয়েই আজকের লেখা। দৈনিক মানবজমিনের খবরের একটি শিরোনাম ছিলো, ‘বাংলাদেশের পোশাক পর্যালোচনার উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের’। হ্যাঙ্গারে ছিলো ‘নকলের অভিযোগ, উদ্বেগে ব্যবসায়ীরা’।
আমরা জানি, আমাদের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, তারপর ইউরোপের দেশগুলো। আমাদের রপ্তানির আয়ের সিংহভাগই আসে অ্যামেরিকা-ইউরোপ থেকে। সুতরাং এমন একটা খবরে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই উদ্বেগের কথাই উঠে এসেছে খবরটিতে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের কথায়। তিনি অভিযোগটিকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ থেকেই এ অভিযোগের গুরুত্ব বোঝা যায়। অভিযোগটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) এর থেকে। অভিযোগ হলো নকল পণ্য তৈরি করে রপ্তানির। না, যুক্তরাষ্ট্র শুধু নয় একই অভিযোগ এসেছে প্যারিসভিত্তিক ইউনিয়ন ডেস ফেব্রিকস (ইউনিফ্যাব) এর কাছ থেকেও। মানবজমিন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার এসোসিয়েশন (এএএফএ) এর অভিযোগ উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘এছাড়া উচ্চ পর্যায়ে চরম দুর্নীতির কারণে বাংলদেশ থেকে অব্যাহত হারে নকল পণ্যের বৈশ্বিক বিস্তার ও উৎপাদন বাড়ছে’। এই একটি লাইনে শুধু পোশাক শিল্প নয়, সামগ্রিক ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। চিহ্নিত করা হয়েছে, আমাদের সামগ্রিক ব্যবস্থার দুর্নীতিকে। বাংলাদেশ থেকে যে বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের নকল পোশাক বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং পোশাকের চালানও জব্দ করার ঘটনা ঘটেছে, এর প্রমাণও দেওয়া হয়েছে এবং সত্যিকার অর্থে প্রমাণ রয়েছেও। এএএফএ জানিয়েছে ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রস্তুত নকল পণ্যের ৫৬টি চালান জব্দ করা হয়েছে। আর এই ঘটনা বাড়ছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বেড়েছে ৫০ শতাংশ। ভয়াবহ কথা। এ ঘটনা শুধু পোশাক শিল্প নয়, আমাদের সামগ্রিক রপ্তানিখাতের জন্যও অশনি সংকেত। আরেকটা কথা, শুধু পোশাক রপ্তানিতেই নয়, নকলের অভিযোগ রয়েছে জুতা, হাতব্যাগ ও গয়নার ক্ষেত্রে। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার। এই একটি দেশেই আমাদের রপ্তানির ১৯ শতাংশের উপর পণ্য যায়। ২০২১-২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু পোশাক রপ্তানিই হয়েছে ৩ লাখ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। যারা এই লেখাটিকে উপেক্ষা করতে চাইবেন তাদের টাকার অঙ্কটা মনে রাখা দরকার। ধরে নিন, যদি এই অভিযোগের ফলে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানিতে কোটা নির্দিষ্ট করে দেয়, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে তবে কী হবে?
সোজা কথায় হাতে হারিকেন। সে সম্ভাবনা যে রয়েছে তা জানিয়েছেন খোদ রপ্তানিকারকরা, দৈনিক মানবজমিন এমনটাই জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও এমন ধারণা করছেন। তিনি বলছেন, এসবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তৈরি পোশাক রপ্তানি হুমকির মুখে পড়বে। এখন প্রশ্ন হলো, এসবের সঙ্গে জড়িত কারা। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই কেলো। যে খুঁজতে যাবে সে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যেতে পারেন। মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীদের স্থাপন করা রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী ভাস্কর্যের মতন, যে ভাস্কর্যটি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু কি পোশাকশিল্প হুমকির মুখে পড়বে? একবার ভাবমর্যাদা নষ্ট হলে পুরো রপ্তানির উপরই এর প্রভাব পড়বে নিশ্চিত। চিংড়িতে জেলি পুশ করে রপ্তানির ফলে যেমনটা হয়েছে। রপ্তানি বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে বাংলাদেশ। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের উপরই আমাদের রপ্তানি বাজার নির্ভর করে। রেমিটেন্সের বড় অংশটাও আসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকেই। সুতরাং ধাক্কাটা সবকিছুর উপরই পড়বে। যা সামলানো আমাদের অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব নয়।
যতই বলুন একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু যারা বলেন তারাও জানেন, এ শুধু সান্ত¡নার কথা। প্রশ্ন উঠলে সেই প্রশ্নের জের সবকিছুর উপর দিয়েই যায়। এই ধাক্কা শুধু পোশাক রপ্তানির ব্যাপার নয়, যে নি¤œআয়ের চাকুরে ডিমের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে আহাজারি করেন, তাও এই ধাক্কার সাথেই সম্পর্কযুক্ত। লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
