
ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারবাজারকে পঙ্গু করে দিয়েছে বিএসইসি : অধ্যাপক আবু আহমেদ, অর্থনীতিবিদ
ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ হয়েছে ৮-৯ মাস হয়ে গেলো। এতে কী লাভ হলো? ফ্লোর প্রাইস আরোপের কোনো যৌক্তিকতা তো প্রমাণ করা গেলো না। তার মানে কী? মানে হচ্ছে বিএসইসির ফ্লোর প্রাইস পলিসি ভুল ছিলো। ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারবাজারকে পঙ্গু করে দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।Ñএমনই অভিযোগ করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ।
তার মতে, বিনিয়োগকারীরা আজ বিতারিত শেয়ারবাজার থেকে! ব্রোকারেজ হাউজগুলো খাঁ খাঁ করছে। বিনিয়োগকারীরা আসেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও কোনো রকম প্রতিবাদ করবেন না। কারণ তাদের আর কয় পয়সা বিনিয়োগ আছে দেশের শেয়ারবাজারে। ফ্লোর প্রাইসের মতো সিদ্ধান্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনুৎসাহিত করছে। বিদেশি বিনিয়োগও আমাদের শেয়ারবাজারে আর আসবে না। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, শেয়ার কিনে বিক্রি করা যায় না, তাহলে কেন আসবো! কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর? বিএসইসি কি দেখে না বিনিয়োগকারীদের হাহাকার? শেয়ারবাজারের এই দুর্দশা। দেখে। কিন্তু দেখেও তা এড়িয়ে যায়।
[৩] আমাদের অর্থনীতিকে এই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন থেকে ৮-৯ মাস আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিলো। শেয়ারের দাম বেধে দেওয়া, এর নীচে যেতে পারবে না। ওই শেয়ারের এখন আর ক্রেতা পাওয়া যায় না। বেচাকেনা করা যায় না। যে কারণে শেয়ারবাজার ২৫০ কোটি থেকে ৩৫০ কোটি ৪০০শ কোটি টাকায় দৈনিক লেনদেন বা শেয়ার বেচাকেনা হয়। শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোনো উৎসাহ নেই। এটি এখন প্রাণহীন বাজার। ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বিনিয়োগকারীরা যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
[৪] অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করাটাই ভুল হয়েছে। আরোপ করার পর আর তা তুলতে চাইছেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তারা। কেন তুলতে চান না ফ্লোর প্রাইস, তা কেবল তারাই জানেন। ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে রাখার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। যদিও বিএসইসি কর্তারা বলেন, ফ্লোর প্রাইস না দিলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যেতেন। কিন্তু ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেক কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা করা যায় না। কারও অসুখ-বিসুখ হলে, টাকার দরকার পড়লেও তো কেউ শেয়ার বিক্রি করতে পারবেন না। টাকা নিতে পারেন না। যে বাজারে বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেছে, সে বাজার তো কোনো বাজারই না। বিশে^র কোনো শেয়ারবাজারেই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেনি। ফ্লোর প্রাইস শব্দটা আছে, কিন্তু কেউ আরোপ করেননি। কিন্তু বিএসইসি করেছে।
[৫] ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, একটা শেয়ারের দাম কমলে ৫টা শেয়ারের বায়ার আছে। কিন্তু শেয়ারের দাম কমতে দিচ্ছে না। একটা শেয়ার বিক্রি করলেই না আরেকটা শেয়ার কিনবে বা বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগকারী তো শেয়ার বিক্রিই করতে পারছেন না। এটাই হয়েছে কাল! ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কেউ ভয়ে কিছু বলতে চান না। কারণ কিছু বললেই ইনকুয়ারি করতে আসবে, এটা করবে, ওটা করবে। বড় বড় বিনিয়োগকারী বা উদ্যোক্তারা এতো মাথা ঘামান না। আবার কেউ কেউ শেয়ারের দাম যখন বেশি ছিলো তখন শেয়ার কিনেছিলো, সেগুলো বেচাকেনা বন্ধ। সার্বিকভাবে বললে, শেয়ারবাজারের পক্ষে আর কিছু নেই। সব পদক্ষেপই বাজারের বিরুদ্ধে।
[৬] ফ্লোর প্রাইস করে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কর্তারা মনে করছেন, তারা এখন নিরাপদ! চা-পানি খান, আর ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দেন। বাজারের করুণ দশা তারা এড়িয়ে যান। আরেকটি কথা সিকিউরিকিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তারা বলেন, বাজার ভালো হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেবেন। কিন্তু বাজার তো ৮ মাসেও ভালো হলো না। তাহলে কখন তারা ফ্লোর প্রাইস তুলবেন? আল্লাহ-ই জানেন।
[৭] শেয়ারবাজার চাঙা করতে কী পদক্ষেপ দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে আবু আহমেদ বলেন, বিএসইসির দায়িত্বে আমি থাকলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতাম। কেন? কারণ ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে বাজার প্রাণ ফিরে পেতো। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হতো। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরতো শেয়াবাজারে। হয়তো সূচক আরও এক-দুইশ পয়েন্ট কমতো। কিন্তু সূচক পড়লে সেটা আবার উঠেও যেতো। ফ্লোর প্রাইস একসঙ্গে তুলতে যদি ভয় পান তাহলে অন্তত আড়াই শতাংশ করে তুলুন। এখন তো শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। কিন্তু নীচে ১০ শতাংশ কমতে পারে না। শেয়ার দাম আড়াই শতাংশ কমতে দিক, তারপর ৫ শতাংশ করুক। তারপর পর্যায়ক্রমে আগের অবস্থানে চলে যাবে। ২০১৭-২০১৯ সাল পর্যন্ত শেয়ারবাজারে প্রাণ ছিলো। বিনিয়োগকারী আসতো। এখন সেটা নেই।
[৮] অনেকে শেয়ারের বিপরীতে ব্রোকারেজ হাউজ থেকে মার্জিন লোন নিয়েছেন। কিন্তু এখন সেই শেয়ারে লাভ তো দূরে থাক, শেয়ার বিক্রি করে ঋণ সমন্বয়ও করতে পারছেন না। বিনিয়োগকারীর সব শেয়ারই তো ঋণদাতা নিয়ে যাবেন! ফ্লোর প্রাইস না থাকলে লোকসানে বিক্রি করেও তো লোনটা ফেরত দিতে পারতো। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগটা নেই।
[৯] শেয়ারবাজার একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু সিএসইসি কর্তারা তা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। বিনিয়োগকারীদের বলা উচিত, আর কতোকাল ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বন্ধ করে বসে থাকবেন। দৈনিক লেনদেন যদি ২০০ কোটি টাকা হয়, তাহলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোরও পোষায় না। তারা হয়তো কিছু বলে না। কারণ অতীতে যে আয় করেছে, তা দিয়েই হয়তো চলে।
[১০] বাই চান্স কোনো কোনো দিন ৮০০-৯০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। কারণ দৈনিক দুই-চারটা আইটেম নিয়ে জুয়া খেলে! মার্জিন লোন যাদের আছে, শর্টটার্ম গেইন যারা করতে চান তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক গত সপ্তাহ ধরে দেখলাম, তারা বসে গেছেন। আর লেনদেন করছে না। ৯০০ কোটি টাকা লেনদেনে নেওয়ার মতো লোকগুলো এখন আর নেই। আগামী ১০-১২ দিনে দেখাক যে আরও দুই-তিন ৯০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। খুব শিগগিরই ৯০০ কোটি টাকা দৈনিক লেনদেন হবে বলে মনে হয় না। কারণ এসব বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ ফ্লোর প্রাইসের পক্ষে। বিএসইসির সঙ্গে তারা কানেকটেড। তারপরও হোক না ভুয়া খেলাধুলা করে ৯০০ কোটি টাকার লেনদেন, কিন্তু সেটাও তো শেষ! যে সমস্ত দুর্বল, জাঙ্ক শেয়ার নিয়ে খেলছে, তাতে প্রত্যেকেই ধরা খেয়েছেন!
[১১] সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তাহলে কী চায়? তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বললে বলেন, স্যার, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইস চান। আমি বললাম, হু আর দ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী? যেখানে বিনিয়োগকারীরা শেষ হয়ে যাচ্ছেন, আপনারা কাদের রক্ষা করতে চাইছেন? সামান্য কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী আছেন, তারাও বিরক্ত হয়ে আমাদের শেয়ারবাজার ছাড়ছেন। চলে যাচ্ছেন। তারা আর কখনো আসবেন না। কেন আসবেন তারা? বুলশিট সব!
[১২] কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বøক মার্কেট থেকে ১০ শতাংশ কমে শেয়ার কেনা যাবে। ঠিক আছে, বুঝলাম। এটা একটা সুযোগ দিয়েছে বা আছে এখনো। কিন্তু বøক মার্কেট থেকে একটা কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে, ৫ লাখ টাকা হতে হবে! মানে যেকোনো একটা কোম্পানির কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার শেয়ার কিনতে হবে! কতোজন বিনিয়োগকারীর কাছে ৫ লাখ টাকা আছে?
[১৩] আগামী ১ বছরের মধ্যে কোনো মিউচুয়াল ফান্ড কোনো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। কারণ তারা বলবেন, আমরা তো আয়ের কোনো সুযোগই পাইনি ফ্লোর প্রাইসের কারণে। পুরো মিউচুয়াল ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস। এক কোম্পানি তো টাকা নিয়ে চলে গেছে। আইসিবি বন্ধ। কোনো কার্যক্রম নেই। বসে বসে বেতন নেয়। কারণ তাদের হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। শেয়ারবাজারের জন্য কোনো ভালো খবর আমি দেখি না। আইসিবি কিছু টাকাপয়সা চেয়েছিলো, নিউজ হয়েছিলো। কিন্তু সেই টাকাপয়সা পাওয়া হলো কোথায়!
[১৪] বিশে^ অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর মধ্যেও অনেক দেশের শেয়ারবাজার খুব ভালো চলছে। আমেরিকা, বোম্বে, ব্যাংকক শেয়ারবাজারও ভালো। আমাদের শেয়ারবাজারও ভালো থাকতো, যদি ফ্লোর প্রাইস না থাকতো। এভারেজ ১২ থেকে ১৪শ কোটি টাকা টার্নওভার থাকতো যদি ফ্লোর প্রাইস না থাকতো। বিএসইসি বলে থাকে, ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে ১০০০ হাজার পয়েন্ট কমে যেতে পারে! তিনদিনে। ১ হাজার পয়েন্ট পড়লে তো ১ হাজার পয়েন্ট ওঠারও সম্ভাবনা থাকে। তাহলে তো অনেক বিনিয়োগকারী আবারও আসবেন বাজারে। শেয়ারবাজারের আকর্ষণই তো হচ্ছে সূচক উপরের দিকে ওঠা, আবার নীচের দিকে নামা। কিন্তু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নীচের দিকে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
