
বিদেশী ক্ষতিকর উদ্ভিদের তালিকায় অনন্য ঔষধিসহ নানা গুণের লজ্জাবতী!

মতিনুজ্জামান মিটু : মাইমোসা বা লতা অনেকটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ। এদেশে অ¤øভাবাপন্ন মাটিতে এক জাতের কাঁটাযুক্ত লজ্জাবতী অহরহ দেখা যায়। এগুলো আকারে অনেটা ছোট। লজ্জাবতী অতি স্পর্শকাতর। কোনোভাবে নাড়া দিলে ছড়ানো পাতা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে অনেক সময় মশা বা ক্ষুদ্র আকৃতির পোকামাকড় পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চাপে মারা যায়। অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসলের মতো লজ্জাবতীর শিকড়ে ‘নডিউল’ গঠন হয়। ফলে মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থ সরবরাহ করায় মাটির উর্বরতা বাড়ে। মাইমোসা বা লজ্জাবতীর লতাপাতা ও ফুলফল পুষ্টিতে অতিসমৃদ্ধ। এতে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিনসহ সব ধরনের খাদ্য উপাদান। বিশেষ করে এটি ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম ও নিয়েসিনে ভরপুর। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় সালাদ, সবজি ও নানা ধরণের স্যুপ হিসেবে ‘মাইমোসা’ আহারের প্রচলন খুব জনপ্রিয়।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এম. এনামুল হক আরও জানান, আফ্রিকার অনেক অধিবাসী চা ও কফির বিকল্প হিসেবে মাইমোসার লতা-পাতা, ফুল ও কচি ফলের নির্যাস পান করে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় ‘জায়েন্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন)’ মহিষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার প্রচলন আছে। ওয়াটার মাইমোসা’র শিকড় ও কচি পাতা শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া ও অনুরূপ মাছের প্রিয় খাবার। অনেক দেশে মাইমোসার যথেষ্ট চাহিদা আছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন ব্যবসায়ী এদেশের লজ্জাবতীর লতা-পাতা সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে জাপানে রপ্তানি করে থাকেন।
ঔষধি গুণাগুণ : লজ্জাবতীর ঔষধি গুণাগুণ অত্যন্ত বেশি। নানা রোগের চিকিৎসায় হারবাল মেডিসিন তৈরিতে এর ব্যবহার যুগযুগ ধরে চলে আসছে। নাক, কান, দাঁত ও ক্ষুদ্রনালির ঘা সারাতে লজ্জাবতীর শিকড় লতা-পাতার ব্যবহার দেশে বিদেশে বহুল প্রচলিত। জন্ডিস, অ্যাজমা, টিউমার, হুপিংকফ, চর্মরোগ, ডায়াবেটিক্সসহ, হার্ট, লিভারের নানা রোগ সারাতে মাইমোসার ঔষধি গুণাগুণ খুব বেশি। লজ্জাবতীর উৎপত্তি স্থান- অনেকে মনে করেন মেক্সিকো লজ্জাবতীর উৎপত্তি স্থান। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ কোস্টাল বেল্টে আফ্রিকার অনেক দেশে ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর লজ্জাবতী দেখা যায়। ট্রপিক ও সাব-ট্রপিকের আওতাধীন সব দেশে লজ্জাবতী ভালও জন্মে। ভারতের রাজস্থানে বিভিন্ন বাগানে কভার ফসল হিসেবে ও গ্রিন ম্যানুয়ারিং ফসল হিসেবে চাষ প্রচলন আছে।
জাত : পৃথিবীতে অনেক রকম জাতের লজ্জাবতী দেখা যায়। তবে জায়ান্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন লজ্জাবতী) ডাঙ্গায় এবং ওয়াটার মাইমোসা অগভীর পানিতে চাষের প্রচলন বেশি দেখা যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এদুটি জাতের চাষাবাদে চাষিদের আগ্রহ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। তবে আস্ট্রেলিয়ার কোনও কোনও এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে তা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ক্ষতিকারক ঘাস হিসেবে চিহ্নিত।
বংশ বিস্তার : প্রধানত: দুইভাবে, বীজ থেকে অথবা পুষ্ট লতা কেটে তা রোপণের মাধ্যমে চাষাবাদ করা যায়। আগস্ট মাস হতে লতায় ফুল ধরা আরম্ভ করে এবং ক্রমান্বয়ে সেপ্টেম্বর হতে ফেব্রæয়ারি মাস পর্যন্ত ফল পাকা আরম্ভ করে। এসময় পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায়। বীজের জীবনী শক্তি খুব বেশি। সংরক্ষিত বীজে ৫০ বছর পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে। মাইমোসার বীজ খুব ছোট। প্রতি ১০০০টা বীজের ওজন প্রায় ৬ গ্রাম।
ওয়াটার মাইমোসা: এটি অগভীর পানিতে ভালো জন্মে। খাল-বিল, নালা-নর্দমা ও পুকুরে সহজেই ওয়াটার মাইমোসার চাষ করা যায়। পুকুর পাড়ের পানির উপরিভাগে ২ থেকে ৩ ফুট দূরত্বে চারা বা কাটিং লাগালে তা দ্রæত কলমির মতো ছড়িয়ে পড়ে। এগাছের লতা সাধারণত ১০ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত ছাড়াতে দেখা যায়। এছাড়াও লতার শাখা প্রশাখা দুইধারে বাড়তে থাকে। লতার প্রতি গিঁটে যে পাতা মঞ্জুরি বের হয় তার প্রতিটির উভয় পাশে জোড়ায় জোড়ায় ২০ থেকে ৪০টা ক্ষুদ্র পাতা গজায় এবং পানির উপরিভাগে বেড়ে ভেসে থাকে। লতার প্রতি গিঁট থেকে প্রচুর গুচ্ছমূল গজায়।
চাষ স¤প্রসারণ : যেসব এলাকায় বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার অগভীর পুকুরের পানি প্রখর রোদে গরম হয়ে যায়। এর প্রভাবে মাছ ও জলজ প্রাণীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব পুকুর পাড়ে ওয়াটার মাইমোসা চাষের মাধ্যমে এপ্রতিকূলতা দূর করা যায়, পানিকে ঠান্ডা রাখা সহজ হয়। ওয়াটার মাইমোসার গুচ্ছ শিকড়ের ভেতর কৈ, তেলাপিয়া মাছে ডিম পাড়ে এবং তা ছোট মাছের আশ্রয় স্থান হিসেবে কাজে লাগে। মাগুর, শিং, কৈ, তেলাপিয়া জাতীয় পুকুরের সব মাছ মাইমোসার শিকড়, কচি লতা-পাতা ও ফুল খেয়ে দ্রæত বৃদ্ধি পায়। উত্তরাঞ্চলের খরা প্রধান এলাকায় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় এজাতের মাইমোসা পুকুর ও নালায় চাষ করে এর সুফল আহরণ করা দরকার।
মহিষের খাদ্য হিসেবে জায়ান্ট মাইমোসার ব্যবহার মালায়শিয়ায় প্রচলিত আছে। তাই এদেশেও তা মহিষের খাবার বা ফডার হিসেবে চাষের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এছাড়াও অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার উপযোগিতা পরীক্ষান্তে অনুকূল ব্যবস্থা নেওয়া যায়। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় ও কিছু আফ্রিকান দেশে সবজি হিসেবে মাইমোসা ব্যবহার প্রচলন অত্যধিক। এদেশেও মাইমোসা শাকসবজি হিসেবে আহারের ব্যবস্থা জনপ্রিয় করার উদ্যেগ নেওয়া যায়।
