
আদানি গ্রুপ, ভারতের শেয়ারবাজার এবং গৌতম আদানির ভবিষ্যৎ

কাজী এম মুর্শেদ
আমি ক্যাপিটাল মার্কেট বা শেয়ারবাজারের প্লেয়ার নইÑ এর মানে এই নয় একদমই বুঝি না। সায়েন্স-কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য বুঝতে সুবিধা হয়, কোর্সে শেয়ারবাজারের উপর কিছু ছিলো সঙ্গে শেয়ারমার্কেটের উপর আমার পছন্দের একটা পিসি গেইম ছিলো বলে তখন থেকে জানি, এই বাজারে আমার ঢোকা হবে না। গেইমটায় প্রতিবার নিউজের সঙ্গে রিলেট করে ডিসিশন নিয়ে হারতাম। শেয়ারবাজার নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রীর কথা ছিলো, এটা ‘ফটকা বাজার’! আমার কাছে এটা কিছুটা ক্যাসিনো, কিছুটা মাফিয়া, বাকিটা পোকার গেইম। এখানে একইসঙ্গে অর্থ থাকতে হবে, ধৈর্য্য থাকতে হবে, বুদ্ধি থাকতে হবে। আপনি লাভ করতে নামবেন, সেই টাকা আরেকজনের ক্ষতি, এখানে বিবেক বলে কিছু নাই। বিবেক দেখাতে গেলে নিজের ক্ষতি।
একটা গান শুনেন কেনি রজার্সের গ্যাম্বলার। একটা কথা হলো তুমি জানো কখন ধরে রাখতে হবে, কখন ছাড়তে হবে, কখন উঠে আসতে হবে, কখন দৌড়ে পালাতে হবে। শেয়ার মার্কেট তেমনই এক ফটকা বাজারের জুয়ার টেবিল। আপনি জিততে গেছেন, কিন্তু হারলে কখন চলে আসতে হবে তার সীমা রাখতে হবে। লাভ হলেও অনেক সময় চলে আসতে হয়। এখানেও ক্যাসিনোর মতো, মালিক যারা তাদের কোনো ক্ষতি নেই। আর মাফিয়াগিরি চলবে, স্টেক বাড়িয়ে এমন জায়গায় নেবে আপনার সামলানোর অবস্থা নেই। চোখের সামনে দেখা বেশ কিছু উদাহরণ আছে, লাভ করেছে গাড়ি-বাড়ি কিনেছে, কিছুদিন পর আত্মীয়-বন্ধুদের গাড়ি কিনে দিয়েছে, এরপর একসময় তাদের কাছ থেকে সেই উপহারের জিনিস নিজের সম্পত্তি বেচে বের হয়ে আসতে হয়েছে। টাকার নেশা সবচেয়ে বড় নেশা, তা অন্যসব নেশার চেয়ে বড় নেশা।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট থেকে বুঝবেন, আদানির যে পতন শুরু করায়, পতন কি আদানির হয়েছে? কিছু না, তারা ধৈর্য্য ধরে আছে। যাঁদের নিজস্ব খনি আছে, সী পোর্ট আছে, এয়ারপোর্ট আছে, জমি আছে, বিশাল ইনফ্রা স্টাবলিশমেন্ট আছে, সঙ্গে সরকার আছে, তাকে নামানো সম্ভব না। এখনো না। মাঝখানে শর্ট সেলার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ বড় অংকের অর্থ বানিয়ে নিয়েছে, যারা সেই সময় শেয়ারবাজারে দাম কমা দেখে বেচে দিয়েছেন তাদের ক্ষতি হয়েছে, আরও ক্ষতি হয়েছে ছোট ছোট ইনভেস্টরদের, তারা পথে বসে গেছে, যারা ধৈর্য্য ধরে বসেছিলো, তাদের কোনো ক্ষতি নেই, আর যারা উল্টো কিনতে গেছে, লাভ তারা অল্প কয়জন করেছে। লাখ লাখ মানুষ এই পুঁজি বাজারে পুঁজি হারিয়েছে, যারা বলছিলো ইন্ডিয়া এলআইসি কেনো শেয়ার কিনছে, তারা এখন হিসাব করতে বসবে এলআইসি কতোটা লাভ করেছে।
দেখেন, যা সাদা চোখে পরিষ্কার দেখা যায়, সেটা সবসময়ই আপনার দেখা না, আপনাকে দেখানো হচ্ছে। আপনি বিশ্বাস করছেন। কারণ তারা দেখাতে পেরেছে। অন্যভাবে চিন্তা করার অভ্যস আমাদের নেই বলেই বিশ্বাস করি চোখের দেখা আর কানের শোনা কথায়। মাথা খাটান, চিন্তা করেন আপনাকে যা দেখানো হয়েছে, সেটার পেছনে উদ্দেশ্য কী, অন্য কিছু কোনো কারণ বা অপশন খোঁজেন, বিশ্বাস করা শেখেন আপনার নিজের বুদ্ধি আছে সেটার উপর অন্য কেউ আপনাকে টেক্কা দিতে পারবে না, তাই যা সঠিক চিত্র দেখায় মূল চিত্র তার উল্টো। এবার আপনি রেজাল্ট পাবেন। শুধু ধৈর্য্য থাকতে হবে, কোনো লাভের বা ক্ষতি কমানোর আশা করবেন না এবং পর্যাপ্ত লোভ থাকতে হবে।
আদানির শেয়ার আর নিট এসেট প্রতিদিন খেয়াল করছি। তার সব কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার বাদে বেশির ভাগ তার হাতে। গৌতমের সঙ্গে আরও চার ভাই, ভগ্নিপতি, সন্তান আছে, তাদের সঙ্গে পার্থক্য, গৌতম আদানি ৮০ শতাংশ ধরে রেখেছেন, বাকিটা অন্যদের। সুতরাং গৌতম আদানির নিজের নিট এসেট দেখলেই বুঝবেন, কোম্পানির স্বাস্থ্য কী। …আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। একদিন এমন কোনো ব্যাপার না, আবার পরতে পারে, তারপরও আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কোন পর্যন্ত নামা যায় আবার উঠতে হবে, সেটা হয়তো আগেই ঠিক করা। একটা ব্যাপার হয়তো আপনারা বোঝেন বা বোঝেন না, সম্পত্তি নিয়ে একটু পরিষ্কার করি।
ফিজিক্যাল এ্যাসেট আর স্টক এ্যাসেট আলাদা জিনিস। আপনারা বিশ্বের বড়লোক বা বিলিয়নিওরদের দেখেন, তাদের মূল এ্যাসেট তাদের পুঁজি বাজারে শেয়ার ভ্যালু, আরেকটা এ্যাসেট হলো আইপিআর বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস। আপনি যদি গৌতম আদানির উপর একটু গভীরে পড়াশোনা করেন, তার এ্যাসেট মূলত ফিজিকাল এসেট। শেয়ারবাজারের দর-ওঠানামা করবে, তাতে কিছু বদল দেখাবে, কিন্তু তার খনি, সী ও এয়ারপোর্ট, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জমি, কৃষি বিনিয়োগ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ব্যবসা, সোলার বিনিয়োগ, ক‚প খনন বিনিয়োগ সবই ফিজিকাল এ্যাসেট। যারা মনে করছিলেন অ্যান্ড অফ আদানি, এবার অন্যভাবে চিন্তা করেন। না হলে যেই প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্ষমতায় না থাকলে আদানি পরে যাবে মনে করছেন, তা হবে না। আদানির দি অ্যান্ড তখনই হতে পারে যখন বিজেপি আর ক্ষমতায় নেই। সেই আশা আপাতত দেখছি না।
লেখক: অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক
