জাতীয় পাট দিবসের ঘোষণা বিজেআরআই ক্যাম্পাসে পাটপণ্যের মেলা বসবে
মতিনুজ্জামান মিটু : জাতীয় পাট দিবসের র্যালী শেষের আলোচনায় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক(বিজেআরআই) কৃষিবিদ ড. মো. আবদুল আউয়াল এঘোষণা দেন। শেরেবাংলা নগরের মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সোমবার বিজেআরআই ক্যাম্পাসে ‘পাট শিল্পের অবদান স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ প্রতিপাদ্যে ‘জাতীয় পাট দিবস’ এর্যালি অনুষ্ঠিত হয়। র্যালিটি বিজেআরআই ক্যাম্পাস হয়ে সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ঘুরে বিজেআরআই’তে ফিরে এসে শেষ হয়। র্যালীতে বিজেআরআই মহাপরিচালক ছাড়াও পরিচালক (কারিগরি) মো. মোসলেম উদ্দিন, পরিচালক (জুট টেক্সটাইল) ড. ফেরদৌস আরা দিলরুবা, পরিচালক (কৃষি) কৃষিবিদ ড. নার্গীস আক্তার এবং পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) কৃষিবিদ ড. এস এম মাহবুব আলীসহ ইনস্টিটিউটের সর্বস্তরের ৪০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন। উল্লেখ্য পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা এবং বাংলাদেশের পাটকে সারা পৃথিবীর কাছে নতুন করে তুলে ২০১৬ সাল থেকে ৬ মার্চ দেশব্যাপী জাতীয় পাট দিবস উদযাপন হয়ে আসছে। আগামীতে শেরেবাংলা নগরের মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বিজেআরআই ক্যাম্পাসে পাট দিবস বহুমুখী পাটপণ্যের মেলা হবে।
বিজেআরআই সূত্র জানান; গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃতভাবে পাট দেশের কর্মসংস্থানে বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে ৮৫ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচাপাট উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য বছরে ৬০ লাখ বেল কাঁচাপাট প্রয়োজন। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দরকার পাঁচ লাখ বেল। পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। এর মধ্যে কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কেবল পাটজাত ব্যাগের চাহিদা ১০ কোটি থেকে ৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে এবং অন্যান্য প্রায় ৭১৭ কোটি টাকার পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে।
পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। পাট শিল্প হলো বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভারী শিল্প, যা বৃটিশ শাসন আমলে এবং পাকিস্তানী আমলের একক বৃহত্তম শিল্প। বর্তমান বিশ্বের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের বৃহদাংশই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে, যা মোট বিশ্ব বাজারের প্রায় ৬৫ শতাংশ। এদেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় তিন শতাংশ পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা তিন ভাগ। প্রতি বছর প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা কৃষক পেয়ে থাকে পাটআঁশ ও পাটখড়ি বিক্রি করে। এদেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস হিসেবে পরিনত হচ্ছে।
পাটখাতের উন্নয়নে পাট ও পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ বা বর্ষপণ্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষনা দিয়েছেন। পাট এখন থেকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে। কৃষি বিপণন আইনমতে কৃষিপণ্য হিসেবে এখন থেকে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। পাশাপাশি পাটপণ্যের মূল্য সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে সহায়তা, অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজার স¤প্রসারণ এবং শিল্প ও ব্যবসার উন্নয়ন, প্রসার, বিপণন কার্যপদ্ধতি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুবিধা পাবে। ইতিমধ্যে পাটচাষিদের কৃষিঋণ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিজেএমসি এর অধীন বন্ধঘোষিত মিলগুলোর পাওনা ও অন্যান্য দায়-দেনা পরিশোধে ৫৭৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রনোদনাসহ পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাট চাষে উদ্ধুদ্ধকরণে পাট আইন-২০১৫, পাটনীতি-২০১৫, বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠান আইন-২০১৫ ও বস্ত্রনীতি-২০১৫ প্রণয়নের উদ্যোগ অন্যতম। পাটচাষীদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে পাটের বীজ উৎপাদনে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ করা হয়েছে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে ঢাকার বুকে তেজগাঁওয়ে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) প্রায় ২৫০ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। রপ্তানিমুখী পাটপণ্য বহুমুখীকরণে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাট ও পাটজাত বর্জ্যের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ, পাটের তৈরী জিন্স (ডেনিম), পাট ও তুলার মিশ্রনে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে তৈরী জুট জিওটেক্সটাইল, পাটখড়ি হতে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) ও পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলী, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গয়না ও গয়নার বক্সসহ ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।
জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিমতন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই কমছে। তাছাড়া জাতিসংঘ ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসেবে ঘোষিত ও পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার আরও উৎসাহিত হয়েছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রানী। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণে পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর শিল্প-রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্গানিক বা পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। সা¤প্রতিক ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগ ও ৩২ মিলিয়ন ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা। তা ছাড়া বিলাসবহুল মোটরগাড়ি নির্মাণ করে এমন পাঁচটি বড় কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটি বড় অংশ তারা পাটজাত পণ্য দিয়ে তৈরি করবে।