সংকট অনেকটাই কেটে যাবে : ড. আতিউর রহমান, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
ভূঁইয়া আশিক রহমান : [২] বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশেপাশের দেশের চেয়ে বেশ ভালো আছে। কিন্তু বেশ খানিকটা চাপেও আছে। বিশেষ করে আমাদের ইমপোর্ট বা আমদানি অনেকটাই কমানো গেছে। যেটা নিয়ন্ত্রণ করে কমানো হয়েছে। এ কারণে লং টার্মে আমাদের ইকোনোমিক গ্রোথে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এ বছর গ্রোথ নিয়ে অতো চিন্তা না করাই ভালো। অর্থনীতিকে মোটামুটি একটা স্ট্যাবিলিটির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রোথ হয়তো আগের চেয়েও কম হবে এ বছর। কিন্তু তাতে মন খারাপ করার কিছু নেই।
[৩] দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আমরা ভেবেছিলাম, বিশে^ মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিশে^র মূল্যস্ফীতি কমেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ইন্টারেস্ট রেট, সেটা তারা বাড়িয়েই চলেছেন। ইন্টারেস্ট রেট বৃদ্ধির ফলে তাদের বন্ডের যে রিটার্ন, সেটাও বাড়ছে। সেটার বৃদ্ধির কারণে যেটা হয়েছে, ইমার্জিং কান্ট্রি থেকে ডলারগুলো ফিরে যাচ্ছে আমেরিকায়। সেজন্য আমাদের মতো দেশে ডলার ইনভেস্টমেন্ট ওইভাবে আসছে না। ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট কিংবা রেমিটেন্স কম আসছে। তারপরও গত মাসে আমাদের এক্সপোর্ট বা রপ্তানি ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। রেমিটেন্স ৪ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আরও বৃদ্ধি করা উচিত।
[৪] বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, আমি মনে করি, আমাদের রেমিটেন্স আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক্সপোর্টও আরও বৃদ্ধি করা যায়। তবে এজন্য খুব দ্রুত যেটা করে ফেলা উচিত, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট ধীরে ধীরে সিঙ্গেল রেটের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এটা আরও তাড়াতাড়ি করে ফেলা উচিত। যাতে প্রবাসীরা মনে না করেন, কয়েকদিন পর আরও রেট বাড়বে, সেজন্য দেশে এখন রেমিটেন্স না পাঠালেও চলবে। এরকম একটা ব্যাপার তারা হয়তো ভাবছেন। ফলে তাদের এ ধরনের ভাবনার সুযোগ না দিয়ে আসছে দুটি ঈদে যাতে দেশে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স আসে, সেজন্য এখনই ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটটা আরও বৃদ্ধি করা উচিত। গত কয়েকদিন আগে ১ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা আরও ১ বা ২ টাকা বৃদ্ধি করে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া দরকার। এমনিতে ২ পার্সেন্ট নরমাল থাকতেই পারে। কিন্তু একটা এক্সচেঞ্জ রেটের দিকে আমাদের দ্রুত চলে যাওয়া উচিত। আমরা যাচ্ছি, কিন্তু সেটা আরও দ্রুত যেতে হবে। মানে একমাস পরে করবোÑএ ধরনের এটিচুড থাকা উচিত নয়।
[৫] ড. আতিউর রহমান বলেন, রোজার মধ্যে প্রচুর প্রবাসী আয় আসবে দেশে। সুতরাং তার আগেই স্পেকুলেট করার যে সুযোগ সেটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যে সরকার ইমিডিয়েট রেসপন্ড করেছে। খুব দ্রুতই আমরা একটা এক্সচেঞ্জ রেটে পৌঁছে গেছি। খুব দ্রুত এই বার্তাটা দিয়ে দিলে প্রচুর রেমিটেন্স আসবে এবং সবাই জানবে, সরকার তার একেবারে চূড়ান্ত এক্সচেঞ্জ রেটের কাছাকাছি চলে গেছে। এখন এটা আর বাড়বে না। এরকম একটা আভাস দিতে হবে। তাহলে কী হবে? প্রচুর প্রবাসী আয় আসবে বাংলাদেশে। এতে আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টের উন্নতি হবে। যদি ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট ভালো হয়, তাহলে আমাদের এক্সপোর্ট আরও বৃদ্ধি পাবে।
[৬] লিকুইডিটির একটা সমস্যা আমাদের অর্থনীতিতে এখনো আছে। মূলত এটা হয়েছে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে যখন ডলার বিক্রি করে, টাকা বাজার থেকে তুলে দেয়। সেখানে তো করার কিছু নেই। আমাদের বিকল্প পথ বের করতে হবে যে, ব্যাংকগুলো আবার একটা লং ট্রার্ম টাকা কীভাবে নিতে পারে, সেই জায়গায় কাজ করার আরও সুযোগ আছে। সেটাও আমরা করতে পারি। ইন্টারব্যাংক মার্কেট যেটা ফরেন এক্সচেঞ্জের, সেটাকে আরও সক্রিয় করা যায়। যাতে সেন্ট্রাল ব্যাংককে আর ডলার বিক্রি করতে না হয়। মার্কেটে যাতে প্রচুর ডলার মেলে, সেই পরিবেশটা তৈরি করতে পারলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেই আমার মনে হয়।
[৭] সবচেয়ে বেশি নজর রাখতে হবে জিনিসপত্রের দামের প্রতি। কারণ এটিই হচ্ছে এই মুহূতে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। জিনিসপত্রের দাম কমাতে হলে মুদ্রানীতি আরও টাইট করা লাগবে। আরেকটু রেট অব ইন্টারেস্টকে নমনীয় করে ফেলা দরকার। যেভাবে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটকে করা হচ্ছে, ইন্টারেস্ট রেটকেও সেভাবে করলে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।
[৮] আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি শহরের চেয়েও ভালো। বিশেষ করে কৃষি খুব ভালো পারফরম করছে। প্রচুর রেমিটেন্স আসছে গ্রামে। গ্রামে লিকুইডিটি সমস্যা অতোটা নেই। গ্রামে এখন মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থা চলে গেছে। মানুষ যখন তখন লেনদেন করতে পারে। সরকার এখন যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়, যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সামাজিক প্রটেকশন প্রচুর যাচ্ছে। তবে একটু খেয়াল রাখা উচিত, এসব যেন ঠিকমতো বিতরণ করা হয়। ডিস্ট্রিবিউশনে যেন কোনো রকম দুর্নীতি না হয়। অথবা প্রভাব বলয়ের মধ্যে যাতে না পড়ে। এটা খেয়াল করতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই ভালো থাকবে। গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো পর্যন্ত গতিশীল আছে। শহরের মানুষ যেসব অনানুষ্ঠানিক খাতে আছে, যারা ওএমএসের চাল বাজার থেকে কিনতে দীর্ঘ লাইন দেন, তাদের দিকে আরও নজর দেওয়া উচিত। ওএমসকে আরও স্ট্রিমলাইন করে ফেলা উচিত। যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাদের জন্য একটা লিস্ট থাকা উচিত এবং যখন তারা যান তখনই যেন জিনিসপত্র পান এরকম একটা ব্যবস্থা করা দরকার।