এশিয়ায় সবচেয়ে ভালমানের তুলা উৎপাদন হয় বাংলাদেশে
মতিনুজ্জামান মিটু : ভারত ও পাকিস্তানসহ এশিয়ার যেসব দেশে তুলা উৎপাদন হয় তারমধ্যে বাংলাদেশের তুলাই সবচেয়ে ভালমানের। কৃষকরা নিজ হাতে তোলাসহ নানাকারণে এদেশের তুলা সবচেয়ে ভালমানের হয় বলে জানানো হয়েছে। এদেশে উৎপাদিত তুলায় ৩২ থেকে ৬০ কাউন্ট পর্যন্ত সূতা তেরী হয়। শতভাগ কটন কাপড় এই তুলাতেই তৈরী হয়। চলতি মৌসুমে দেশে ২ লাখ বেলেরও বেশি তুলা উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সুত্রে বরাতে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. ফখরে আলম ইবনে তাবিব জানান, ২০২১-২২ মৌসুমে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ১৩টি জোনে ৪৪ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে এক লাখ ৯৫ হাজার বেলা আঁশ তুলা উৎপাদন হয়।
দেশি বিদেশি মিলিয়ে বর্তমানে মোট ৮৫ লাখ বেল তুলার চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত হয় মাত্র ২লাখ বেল। দেশের মানুষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে লাগে ১৬ লাখ বেল কাঁচা তুলা। বাণিজ্যিককাজে বা দেশের তেরী পোষাকের চাহিদা মেটাতে আমদানী করতে হয় বাকী তুলা। দেশে উৎপাদিত তুলা দিয়ে যার ১২ শতংাশ থেকে ১৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়। দেশে উৎপাদিত তুলায় মোট চাহিদার ২.৫০ শতাংশ থেকে ৩.০০শতাংশ মেটানো যায়।
তুলা উন্নয়ন বোর্ড সুত্রমতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানসহ অনেক দেশ রপ্তানী না করায় এদেশের বস্ত্রশিল্পে তুলার ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। সেসময় দেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসংকট উপলব্ধি করেন এবং সংকট নিরসনে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠনে করেন। পরে ১৯৭৬ সাল থেকে এদেশে তুলার চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯১ সালে তুলা গবেষণা কার্যক্রম তুলা উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া হয়।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. ফখরে আলম ইবনে তাবিব, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. কামরুল ইসলাম ও সিনিয়র জিনিং অফিসার মুহাম্মদ মোফাজ্জেল হোসেন জানান; তুলা উন্নয়ন বোর্ড গবেষণার মাধ্যমে একটি হাইব্রিড (সিবি হাইব্রিড) জাত উদ্ভাবন করে, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট(বিনা) এবং আইএইএ( ইন্টারন্যাশনাল এ্যটমিক এনার্জি এজেন্সি) এর কারিগরি সহায়তায় তুলার একটি মিউটেন্ট জাত(সিডিবি তুলা এম-১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২৪টি জাত এবং ৫৫টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে সমভূমির উচ্চফলনশীল ১৯টি, পাহাড়ি ৩টি ও হাইব্রিডের ১টি জাত রয়েছে। সিডিবি তুলা এম-১ জাতের তুলা উৎপাদনে কম সময় লাগে এবং বেশি ঘনত্বে বোনা যায়।
একসময় আমেরিকান ও স্পটেড বোলওয়ার্মের আক্রমণে তুলা চাষের ব্যাপক ক্ষতি হতো। বর্তমানে তুলার জাতগুলোতে এপোকার আক্রমণ তেমন দেখা যায়না। ২০০০ সাল থেকে তুলা ফসলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) চালু হওয়ায় তুলার রোগ বালাই অনেকাংশে কমেছে, ফলনও বেড়েছে অনেক। শুরুর দিকে আমেরিকান ডেল্টাপাইন জাত দিয়ে দেশে তুলা চাষ হতো। ২০০৭-২০০৮ মৌসুম পর্যন্ত স্থানীয় জাতে বিঘাপ্রতি ফলন ছিলও ছয় থেকে সাত মণ। যা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে বিঘায় ১৫ থেকে ২০মণ। এদিকে ফলন আরও বাড়াতে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।
তুলা একটি আঁশ জাতীয় ফসল এবং এর বীজ হতে উপজাত হিসেবে ভোজ্য তেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলা বীজ হতে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ ভোজ্য তেল ও ৮০ শতাংশ শতাশ উন্নতমানের খৈল পাওয়া যায়। উৎপাদিত তুলা বীজ জিনার বা জিনিং ইন্ডস্ট্রিতে প্রধান পণ্য হিসেবে আঁশ তুলা পাওয়া যায়। আঁশ তুলা টেক্সটাইল মিলে নির্ধারিত দামে বিক্রি করা হয়। যা পরে ডমেস্টিক মার্কেটগুলো এবং বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। এআঁশ তুলা থেকে প্রথমে সূতা ও পরে কাপড় তেরী হয়। এদেশে উৎপাদিত তুলায় ৩২ থেকে ৬০ কাউন্ট পর্যন্ত সূতা পাওয়া যায়। তুলা বীজ হতে উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় ভোজ্য তেল ও খৈল। অপরিশোধিত তেল সাবান তেরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরিশোধিত তেল রিফাইনারিতে পরিশোধন করে ভোজ্য তেল এবং তুলা বীজের খৈল গবাধি পশু, মুরগী ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া তুলাবীজের গায়ে লেগে থাকা ক্ষুদ্র আঁশ বা লিল্টারস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার করে টিস্যু পেপার, বøটিং পেপার, গজ, ব্যান্ডেজ, ডাক্তারী তুলা ও কার্পেটের সুতা তেরী হয়ে আসছে।