
বাংলাদেশের সমুদ্রে ২৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে মনোযোগী হলে অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠবে : মো. খুরশেদ আলম, সচিব, মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট

রাশিদুল ইসলাম,
[২] করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে বিশ^ব্যাপী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন দেশের আমদানি ও রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিভিন্ন দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে। রয়েছে ডলারের সংকট। এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়মতো অর্থের যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ডলারের সংকটে শুধু যে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি হ্রাস পাচ্ছে তা নয় একইসঙ্গে ওষুধ, খাদ্যপণ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এই যখন অবস্থা তখন বাংলাদেশ সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে মনোযোগী হয়ে উঠলে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব মো. খুরশেদ আলম।
[৩] গত ৫ দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার আনুমিক ১.৫২ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সমুদ্র সীমা জয়ের পর বাংলাদেশের আয়তন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও ২৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের একার পক্ষে এ সম্পদ আহরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মো. খুরশেদ আলম। সেন্ট মার্টিনে সিন্দবাদ এক্সপেরিয়েন্স রিসোর্টে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স আয়োজিত ‘বøু-ইকোনোমি অ্যান্ড বøু-ট্যুরিজম’ বিষয়ে আবাসিক প্রশিক্ষণে তিনি একথা বলেন।
[৪] বøু-ইকোনোমি বা সুনীল অর্থনীতিকে পরবর্তী মহান অর্থনৈতিক সীমান্ত হিসাবে বলছে ইউনিসেফ। বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষ উপক‚লীয় অঞ্চলের কাছাকাছি বাস করে, ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য মহাসাগর ব্যবহার করে এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সমুদ্র ব্যবহার করে অর্জিত হয়। মহাসাগর, সমুদ্র এবং উপক‚লীয় অঞ্চল খাদ্য নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্যদূরীকরণে অবদান রাখে এবং তবুও সমুদ্রগুলো মানব ক্রিয়াকলাপের দ্বারা মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছে, যেখানে অর্থনৈতিক লাভ সম্ভব হয়ে উঠছে পরিবেশগত অবনতির কারণে। অ্যাসিডিফিকেশন, দূষণ, সমুদ্রের উষ্ণতা, ইউট্রোফিকেশন এবং মৎস্য পতন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের পরিণতির কিছু উদাহরণ মাত্র। এই হুমকিগুলো গ্রহের জন্য ক্ষতিকর এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া যা সমুদ্র এবং তাদের উপর নির্ভরশীল মানুষদের রক্ষা করার জন্য জরুরি পদক্ষেপের দাবি করে। নতুন ডেটাসেটের উপর ভিত্তি করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থান সমুদ্রভিত্তিক শিল্পগুলোতে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। ছয়টি মহাসাগর ভিত্তিক শিল্পের মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ ধরা, সামুদ্রিক জলজ পালন, সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াকরণ, জাহাজ নির্মাণ, সামুদ্রিক যাত্রী পরিবহন এবং সামুদ্রিক মাল পরিবহন।
[৫] সমুদ্র কীভাবে অর্থনীতিতে সাহায্য করে? জলবায়ু এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকার পাশাপাশি এবং গুরুত্বপূর্ণ ইকো সিস্টেম পরিষেবা প্রদানের জন্য, সমুদ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্য অত্যাবশ্যক, ৯০ শতাংশেরও বেশি বাণিজ্য সমুদ্রপথ ব্যবহার করে এবং লাখ লাখ মানুষের কাজের উৎস হিসাবে। বøু ইকোনোমি বা নীল অর্থনীতি একটি অর্থনৈতিক শব্দ, যা সামুদ্রিক পরিবেশের শোষণ এবং সংরক্ষণের সাথে যুক্ত এবং কখনও কখনও টেকসই সমুদ্র-ভিত্তিক অর্থনীতির প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মহাসাগর আমাদের খাওয়ায়, আমাদের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমরা যে অক্সিজেন শ্বাস নিই তার বেশির ভাগই উৎপন্ন করে। তারা বিশ্বের বেশির ভাগ অর্থনীতির ভিত্তি হিসাবেও কাজ করে, পর্যটন থেকে মৎস্যসম্পদ থেকে আন্তর্জাতিক শিপিং পর্যন্ত খাতকে সহায়তা করে।
[৬] একটি টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি কী? সহজ কথায়, একটি টেকসই মহাসাগর অর্থনীতি এমন একটি যেখানে মানবতা কার্যকরভাবে সামুদ্রিক এবং উপক‚লীয় বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করে, টেকসই উপায়ে সামুদ্রিক খাবারের মতো সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার করে এবং নিশ্চিত করে যে সমুদ্র এবং মহাসাগরের শিল্পের সুবিধাগুলো ন্যায্যভাবে ভাগ করা হয় এবং ভবিষ্যতে স্থায়ী হতে পারে। একইসঙ্গে টেকটোনিক্স এবং সামুদ্রিক বিপদসহ গ্রহ-স্কেল প্রক্রিয়াগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য মহাসাগরগুলো অন্বেষণ এবং ম্যাপিং আমাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে সহায়তা করবে।
[৭] সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং একটি শক্তিশালী রপ্তানি বাজারের কারণে ২০৩৭ সালের মধ্যে ১৯১টি দেশের মধ্যে ২০ তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে এমনটি বলা হলেও মো. খুরশেদ আলম মনে করেন বিষয়টি অতটা সহজ নয়। তিনি বলেন, বিশে^র সবচেয়ে বড় শিপব্রেকিং শিল্প বাংলাদেশে এবং এ খাত থেকে বর্জ্য শুধু নদী বা সমুদ্র দূষণ করছে না, ক্যান্সার ভয়াবহ রকমে বেড়ে গেছে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে থাইল্যান্ড বছরে ৯ আর ইন্দোনেশিয়া ১২ বিলিয়ন ডলার আয় করলেও বাংলাদেশের আয় হয় এখাতে সাড়ে ৪শ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু মো. খুরশেদ আলম বলছেন, একক কারো প্রচেষ্টায় বøু ইকোনমি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এরজন্যে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। গার্মেন্টস খাতে যত সহজে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছে সমুদ্র সম্পদ আহরণে তা হচ্ছে না। ২০১৪ সালের ৭ জুলাই বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। আদালতে যাওয়ার আগে এ সমুদ্র সীমা ছিল মাত্র ১শ মাইল। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র ভূমির পরিমান দাঁড়িয়েছে ৮১ শতাংশ। অথচ নদী ভ‚মির পরিমান মাত্র ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু এখনো বাংলাদেশ গভীর সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের সক্ষমতা অর্জন করেনি।
[৮] বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা স্কোর হলো ৫৪.৪, যা এর অর্থনীতিকে ২০২৩ সূচকে ১২৩তম দেশ হিসেবে বিশে^ যুক্ত করেছে। এর স্কোর গত বছরের তুলনায় ১.৭ পয়েন্ট ভালো। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২৬তম স্থানে রয়েছে এবং এর সামগ্রিক স্কোর আঞ্চলিক ও বিশ্ব গড় থেকে কম। একটি দেশের অর্থনীতির আকার সাধারণত তার মোট দেশীয় পণ্য বা জিডিপি হিসাবে প্রকাশ করা হয়, যা এক বছরে দেশের মধ্যে উৎপাদিত সমস্ত পণ্য ও পরিষেবার প্রবাহ থেকে মান পরিমাপ করে।
[৯] বঙ্গোপসাগরে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চলা সমুদ্রসীমা নিয়ে এ বিরোধের অবসান ঘটায় বাংলাদেশ লাভ করেছে একটি স্থায়ী সমুদ্রসীমা। জার্মানিতে অবস্থিত স্থায়ী সালিশী আদালত বাংলাদেশের পক্ষে এ রায় দেয়। এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপুল অঞ্চলজুড়ে তার পূর্ণ অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মো. খুরশেদ আলম বলেন, বাংলাদেশ জাহাজে পণ্য আমদানি ও রফতানি হয় ১২০ বিলিয়ন ডলারের। হাজার পাঁচেক জাহাজে এসব পণ্য ভাড়া বাবদ পরিশোধ করতে হয় ৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মালিকানায় মাত্র ৮২টি জাহাজ রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ‘শর্টটার্ম’ লাভের জন্যে এখাতে এগিয়ে আসতে চান না। জাহাজের ব্যবসায় মাত্র দশমিক ৮৪ শতাংশ মালিকানা বাংলাদেশিদের। আড়াই শতাংশ মাছ আহরণ করতে পারি। জালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে জাহাজ ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে। একটি জাহাজ সমুদ্রে ভাসাতে ১৬টি মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়।
[১০] উন্নত বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার সময়েও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের শক্তিশালী ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। একটি শক্তিশালী জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ, শক্তিশালী তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি, স্থিতিস্থাপক রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা গত দুই দশক ধরে দ্রæত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করেছে। কিন্তু কোভিড পরবর্তী বিশ^ব্যাপী ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, জালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ইউক্রেন যুদ্ধ, রেমিটেন্স প্রবাহ হ্রাস পাওয়া অর্থনীতিতে নতুন খাত সৃষ্টি জরুরি হয়ে পড়েছে।
[১১] ২০১৫ সালে, সমস্ত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র টেকসইতার উপর একটি উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করেছে, যা ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য কেন্দ্রিক। এ ১৭টি লক্ষ্য মানুষের এবং গ্রহের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য একটি বৈশ্বিক নীলনকশা দিয়েছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্যে বিভিন্ন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশ টেকসই উন্নয়নের জন্য সমুদ্র, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সমুদ্রের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দাবি জানায়। এজন্যে আমাদের গ্রহকে রক্ষা করার জন্য সর্বজনীন পদক্ষেপের প্রয়োজন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাহিনীকে বাস্তবায়নের আহŸান জানানো হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অনেক দূরে রয়েছে, যা আজকের পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
[১২] মহাসাগর এবং সমুদ্রগুলো খাদ্য, শক্তি এবং খনিজগুলোর একটি মূল উৎস এবং একাধিক খাতের ক্রিয়াকলাপের জন্য আরও বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ উদাহরণ হলো মৎস্য ও জলজ চাষ এবং এই সম্পদগুলির প্রক্রিয়াকরণ এবং বাণিজ্য। নৌযানগুলোর জন্য কনটেইনারশিপ, ট্যাঙ্কার এবং বন্দর আকারে বিশ্বায়িত বাজারেও সামুদ্রিক পরিবহন একটি বড় ভ‚মিকা পালন করে। একইসঙ্গে উপক‚লীয় পর্যটন হলো কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমুদ্র সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবসা।
[১৩] গত কয়েক বছর ধরে, ‘ব্রæ ইকোনোমি’ শব্দটির ব্যবহার বেড়েছে এবং টেকসই উন্নয়ন, অর্থনীতি এবং সমুদ্রের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে জাতিসংঘ, ইইউ, ওইসিডি এবং বিশ্বব্যাংক ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ‘নীল অর্থনীতি’ একটি অর্থনৈতিক শব্দ যা সামুদ্রিক পরিবেশের শোষণ এবং সংরক্ষণের সাথে যুক্ত এবং কখনও কখনও টেকসই সমুদ্র-ভিত্তিক অর্থনীতি’এর প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তবে, সঠিক সংজ্ঞার উপর কোনো ঐকমত্য নেই এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রটি এটি ব্যবহারকারী সংস্থার উপর নির্ভর করে। জাতিসংঘ ২০১২ সালে একটি সম্মেলনে প্রথম ‘নীল অর্থনীতি’ প্রবর্তন করে এবং টেকসই ব্যবস্থাপনাকে আন্ডারলাইন করে, এই যুক্তির উপর ভিত্তি করে যে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রগুলো সুস্থ থাকলে আরও বেশি উৎপাদনশীল। এটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান দ্বারা দেখা গেছে পৃথিবীর সম্পদ সীমিত এবং গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি গ্রহের ক্ষতি করছে। একই সঙ্গে দূষণ, টেকসই মাছ ধরা, বাসস্থান ধ্বংস ইত্যাদি সামুদ্রিক জীবনের ক্ষতি করে এবং তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
[১৪] জাতিসংঘ সমুদ্র, সমুদ্র এবং উপক‚লীয় অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপের একটি পরিসর হিসাবে নীল অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্ট করে দেখে কার্যক্রমগুলো টেকসই এবং সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত কিনা। নীল অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয় হল টেকসই মাছ ধরা, সমুদ্রের স্বাস্থ্য, বন্যপ্রাণী এবং দূষণ বন্ধ করা। জাতিসংঘ আরো বলে যে বøæ ইকোনোমিকে ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, জীবিকার সংরক্ষণ বা উন্নতির প্রচার করা উচিত। একই সময়ে সমুদ্র এবং উপক‚লীয় অঞ্চলের পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় জাতিসংঘ। এটি সীমান্ত এবং সেক্টর জুড়ে বৈশ্বিক সহযোগিতার গুরুত্বকে নির্দেশ করে।
[১৫] সমুদ্র, মহাসাগর এবং উপক‚লীয় অঞ্চলের ব্যবহার বিগত বছরগুলোতে ত্বরান্বিত হয়েছে। ওইসিইডি সমুদ্রকে পরবর্তী মহান অর্থনৈতিক সীমানা হিসাবে বর্ণনা করে। কারণ এটি সম্পদ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং উদ্ভাবনের সম্ভাবনা রাখে। এবং অর্থনীতিতে মৎস্য, উপক‚লীয় পর্যটন এবং শিপিংয়ের মতো বিদ্যমান ব্যবসাগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এটি নতুন উদীয়মান সেক্টরগুলোর বিকাশের উপরও দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যেগুলো ২০ বছর আগে অস্তিত্বহীন ছিল যেমন নীল কার্বন সিকোয়েস্টেশন, সামুদ্রিক শক্তি এবং জৈবপ্রযুক্তি; সেক্টরিয়াল ক্রিয়াকলাপ যা প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা এবং সুযোগ তৈরি করে, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই লড়াই সঠিকভাবে করতে না পারলে কি হতে পারে তার একটি জ¦লন্ত উদাহরণ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী স্থানান্তর। প্রকৃতির বিপদসঙ্কেতে ইন্দোনেশিয়ার নতুন রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জাকার্তা থেকে ২০০০ কিমি দূরে। ঘিঞ্জি, দূষিত, ভ‚মিকম্প প্রবণ এলাকা তো ছিলোই। এবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সমুদ্র ধীরে ধীরে গিলছে জাকার্তাকে। তড়িঘড়ি দেরি না করে দ্রæত রাজধানী সরাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। জাকার্তা থেকে রাজধানী সরিয়ে বোর্নিও দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার আধিকারিকরা বলছেন, নয়া শহর স্থায়ী অরণ্য শহর হিসাবে গড়ে উঠবে।
[১৬] পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়নকে কেন্দ্র করে শহর গড়ে উঠবে। এই শহর ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন-নিয়ন্ত্রিত হবে। তবে পরিবেশবিদরা সতর্ক করছেন, রাজধানী গড়লে ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন হবে। তাতে বিরল প্রজাতির প্রাণী বিশেষ করে ওরাংওটাং, ইমপেরিলের মতো জনজাতি উচ্ছেদের শিকার হবেন। জাকার্তায় ১ কোটি মানুষের বাস এবং গ্রেটার মেট্রোপলিটন এলাকার প্রায় তিনগুণ বেশি। কিন্তু এই শহরই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রæত ডুবন্ত শহর। আর যে হারে এটি ডুবছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে শহরের এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার অন্যতম কারণ যথেচ্ছভাবে ভ‚গর্ভস্থ জল বেরিয়ে যাওয়া। তবে জাভা সাগরে জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এতে প্রভাব পড়েছে। বায়ু এবং জল ভীষণভাবে দূষিত, বারবার বন্যায় ভাসে। আর রাস্তাঘাট এতো জলমগ্ন হয় যে প্রতিবছর তার জন্য সরকারের ৪৫০ কোটি খরচ হয়। প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো চাইছেন, যে হারে জাকার্তায় জনসংখ্যা বাড়ছে, নির্মাণকাজ হচ্ছে তার থেকে শহরকে মুক্তি দিতে নতুন জায়গায় রাজধানী সরানো হচ্ছে। তাতে নতুন স্থায়ী শহর তৈরি করে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
[১৭] ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের স্বপ্নের শহর হচ্ছে নুসানতারা। জাভার এই শব্দের অর্থ দ্বীপপুঞ্জ। এখানে সরকারি ভবন এবং ঘরবাড়ি তৈরি হবে। প্রাথমিক ভাবে ১৫ লাখ সরকারি কর্মীকে সপরিবারে এখানে স্থানান্তর করা হবে। জাকার্তার উত্তর-পূর্বে ২ হাজার কিমি দূরে অবস্থিত নুসানতারায় মন্ত্রণালয় এবং সরকারি দফতর স্থানান্তর করা হবে। বামবাং সুসানতানো, নুসানতারা জাতীয় রাজধানী কর্তৃপক্ষের প্রধান বলেছেন নয়া রাজধানী অনেকটা অরণ্য শহরের মতো হবে। ৬৫ শতাংশ অঞ্চল হবে অরণ্য। আগামী বছর ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা দিবসে নুসানতারার উদ্বোধন হবে। তবে শহর ২০৪৫ সালের আগে পুরোপুরি তৈরি হবে না। সেই বছরই ১০০ বছর হবে ইন্দোনেশিয়ার।
[১৮] এতোকিছুর পরও সমুদ্রে আবর্জনা ফেলা থেমে নেই। গবেষকরা জানিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে ১৭১ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক টুকরা রয়েছে। এর সম্মলিত ওজন হবে ২.৩ মিলিয়ন টন! জীবনের শুরু হয়েছিল এই সমুদ্রে। এখনও মানবসভ্যতা টিকে আছে এই সমুদ্রের ওপর নির্ভর করেই। পৃথিবীর ৭০ ভাগ প্রাণের বসবাস এই সমুদ্রে। এছাড়া ডাঙায় থাকা প্রাণীদের জন্য সরবরাহ করা অক্সিজেনেরও বেশির ভাগ আসে এই সমুদ্র থেকেই। কিন্তু মানুষের দূষণের কারণে সেই সমুদ্রই আজ বিপন্ন হওয়ার পথে। সিএনএন জানিয়েছে, ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের পর এই ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল। আটলান্টিক, প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরের পানি বিশ্লেষণ করেছেন তারা। অন্তত ১২ হাজারটি স্থান থেকে তারা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৫ সালের পর থেকে প্লাস্টিক দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
[১৯] গাইরেস ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক লিসা এরডল সিএনএনকে বলেন, এটি আগের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি। যে হারে প্লাস্টিক সমুদ্রে প্রবেশ করছে জরুরি নীতিগত পদক্ষেপ না নিলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ ২.৬ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। গত কয়েক দশকে প্লাস্টিক উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গতিশীল হয়নি। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকিগুলো সব পরিবেশে মিশে যাচ্ছে এবং দূষণ ঘটাচ্ছে।
[২০] সেই প্লাস্টিক বর্জ্যের বিপুল পরিমাণ সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। বেশির ভাগই ভ‚মি থেকে আসে। নদী, বৃষ্টি, বাতাস কিংবা ড্রেনের মাধ্যমে এগুলো সমুদ্রে জায়গা করে নেয়। তাছাড়া সমুদ্রেও মাছ ধরার নৌকাগুলো প্রচুর প্লাস্টিক ফেলে। প্লাস্টিক কখনো পচে যায় না। এগুলো বরঞ্চ ছোট ছোট টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। এই কণাগুলোকে সমুদ্র থেকে পরিষ্কার করাও কঠিন। সামুদ্রিক জীবনও এই প্লাস্টিকের কারণে বিপন্ন হওয়ার পথে। তারা এই প্লাস্টিকের বর্জ্যে আটকে যায়। আবার খাবার মনে করে গিলে ফেলে। এতে বিলিয়ন বিলিয়ন সামুদ্রিক প্রানির মৃত্যু হয়েছে। প্লাস্টিক শুধু একটি পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, প্লাস্টিক একটি বিশাল জলবায়ুগত সমস্যাও। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেও ভ‚মিকা রাখে প্লাস্টিক।
