
ব্যবসায় কতো শতাংশ লাভ করা শরীয়তসম্মত?

জিল্লুর রহমান
রমজান এলেই আমাদের দেশে পণ্যের দাম বাড়ে, এই বাড়ানো দামকে আবার ব্যবসা বলে জায়েজ করে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অনেক আলেম বলে থাকেন কোরআন এবং হাদিসে নাকি কতো পরিমাণ ব্যবসা করা যাবেÑ এমন কিছু উল্লেখ নেই, ইসলামে বিষয়টিকে নাকি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এটি আল্লাহর উপরে অপবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়, এমনই যদি হয় তবে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হয় কী করে? কোরআনে অবশ্যই কী পরিমাণ ব্যবসা করা যাবে এর মূলনীতি বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন: হে মুমিনগণ। তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে যদি তা তোমাদের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসার মাধ্যমে হয় তাহলে ভিন্ন কথা- (সূরা নিসা: ২৯)।
ব্যবসা কী? ব্যবসা হচ্ছে পারস্পরিক ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি। কোরআনের এই ঘোষণাই ব্যবসার মূলনীতি। পণ্যের ধরন, সময় এবং অবস্থার নিরীখে কোন পণ্যে কত লাভ করতে হবে সেটি ইনসাফ মোতাবেক নির্ধারণ করাই সুন্নাহ সম্মত ব্যবসা। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য যদি কিনতেই বেশি পড়ে যায়, তাহলে ইচ্ছে করলেও সেটা বাজারে কম দামে বিক্রি করতে পারবেন না, আবার দেশে উৎপাদিত পণ্য চাহিদার কারণে অতিরিক্ত মুনাফা করবেন এটি ইনসাফ নয়, কৃষকের কাছ থেকে কিনতে তাকে ঠকাবেন, এটিও ইনসাফ নয়। পণ্য বিক্রয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। ইন্সাফ এমন একটি শব্দ যার মাধ্যমে আপনি বহু বিষয়ের সমাধান করতে পারবেন, আল্লাহ সুরা আর রহমানে ন্যায্যতা কায়েমের কথা বলেছেন ‘মিজান’ শব্দের মাধ্যমে, কিন্তু আমরা একে ওজন মনে করে আমল করছি।
ব্যবসায় অবশ্যই লাভ করবেন, কিন্তু কত শতাংশ? এই প্রসঙ্গটি এলে প্রথমেই একটি হাদিসের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়, হাদিসটি নি¤œরূপ। নবী করীম (সা:)-এর নিকট পশুর একটি চালানের সংবাদ আসল। তিনি আমাকে একটি দীনার দিয়ে বললেন, উরওয়া। তুমি চালানটির নিকট যাও এবং আমাদের জন্য একটি বকরী ক্রয় করে নিয়ে আস। তখন আমি চালানটির কাছে গেলাম এবং চালানের মালিকের সঙ্গে দরদাম করে এক দীনার দিয়ে দুইটি বকরী ক্রয় করলাম। বকরী দু’টি নিয়ে আসার পথে এক লোকের সঙ্গে দেখা হয়। লোকটি আমার থেকে বকরী ক্রয় করার জন্য আমার সঙ্গে দরদাম করল। তখন আমি তার নিকট এক দীনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রয় করলাম এবং একটি বকরী ও একটি দীনার নিয়ে চলে এলাম। তখন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)। এই হচ্ছে আপনার দীনার এবং এই হচ্ছে আপনার বকরী। তখন রাসূল (সা.) বললেন, এটা করলে কীভাবে? উরওয়া বলেন, আমি তখন তাঁকে ঘটনাটি বললাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আল্লাহ। আপনি তার হাতের লেন-দেনে বরকত দিন’- (বুখারী, হাদিস: ৩৬৪২; আবু দাঊদ, হাদিস: ৩৩৮৪; তিরমিযী হাদিস: ১২৫৮)।
এই ঘটনাটি সত্য ধরে নিয়ে কিছু বিষয় খুব ভালো করে লক্ষ্য করুন। প্রথমত: এই হাদিসটি ব্যবসা সংক্রান্ত নয়, রাসুল (সা.) ব্যবসার উদ্দেশে বকরী কিনতে সাহাবি (রা.)-কে পাঠাননি, অন্য কোনো উদ্দেশ্য হতে পারে, রাসুল (সা.) বকরীর দায়িত্বশীল ছিলেন, ব্যবসায়ী ছিলেন এমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত: এই হাদিসের একটি অংশে বলা হয়েছে ১ দিনার দিয়ে দু’টি বকরী কিনেছেন, কিন্তু তখন এক দিনারে দু’টি বকরী নয়, একটি বকরীই পাওয়া যেতো। ১৪৫০ বছর আগে মক্কায় ৮০ দিরহাম দিয়ে একটি উট, ১ দিনারে একটি একটি ছাগল পাওয়া যেত। তৃতীয়ত: ব্যবসার উদ্দেশে বকরী ক্রয় করতে দিলে সাহাবী দু’টি বকরীই বিক্রি করে দিতেন, ১ দিনার আর ১ টি বকরি ফেরত নিয়ে আসতেন না। ব্যবসার নিমিত্তে মাত্র ১ দিনার মূলধন রাসুলুল্লাহ (সা.) বিনিয়োগ করবেন?
চতুর্থত: রাসুলুল্লাহ শেষে এই বলে দোয়া করেছেন যে, তোমার হাতের লেনদেনে বরকত হোক, হাতের লেন দেন যে ব্যবসা নয় সেটা আমরা সবাই জানি, পণ্যের লেনদেন হচ্ছে ব্যবসা। উপরোক্ত হাদিসটি ব্যবসা সংক্রান্ত নয়, বরকত সংশ্লিষ্ট। একে ব্যবসার উদাহারণ হিসেবে টেনে যা ইচ্ছা তাই ব্যবসা করবেন এটি উচিত হবে না। ব্যবসা চাইলে কেউ দ্বিগুণ করতে পারেন, যেমন বিলাসী দ্রব্যের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভেতরে। কিন্তু এই নীতি সব পণ্যের ক্ষেত্রে নয়, বিশেষ করে জীবনরক্ষাকারী খাদ্যপণ্যগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই বেশির ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, এটাই ব্যবসার মূলনীতি, এটাই সুন্নাহ। ব্যবসায় কতো মুনাফা করবেন তার একটি মৌলিক নীতি রয়েছে, লাভের সর্বনি¤œ সীমা সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছেন, সম্পদ ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে কমপক্ষে এতটুকু লাভ করা যায় যাতে ব্যবসায়ীর পরিবারের ভরণ-পোষণ, ব্যবসার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান ও ২.৫ শতাংশ যাকাত দেওয়ার পর মূলধন অক্ষত থাকে। লেখক: সাংবাদিক
