ক্রেডিট সুইসের অধিগ্রহণ
রাশিদ রিয়াজ : গত কয়েক বছর ধরে ক্রেডিট সুইস বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে আসছিল। গত বছর বিশ^ মন্দায় পড়ে সবচেয়ে বড় রেকর্ড লোকসান দেয় ক্রেডিট সুইস। কিন্তু গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের পতনের পর আর সামাল দিতে পারেনি ক্রেডিট সুইস। ১৬৭ বছরের এ ব্যাংকটির এক সপ্তাহে ২৫ শতাংশ শেয়ার পতন ঘটে। বিনিয়োগ তহবিল থেকে অকাতনে অর্থের যোগান দিয়েও শেষ রক্ষা হয়।ি কারণ ততক্ষণে ব্যাংকটির গ্রাহকরা প্রতিদিন ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমানত তুলে নিতে শুরু করে। খবর- সিএনএন, ফিনান্সিয়াল টাইমস, ইকোনমিস্ট
সুতরাং ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইসের এ অধিগ্রহণ ছিল অপরিহার্য এবং তা ঐতিহাসিক হয়ে থাকল। সুইজ্যারল্যান্ডের ব্যাংকিং জায়ান্ট ইউবিএস তার প্রতিদ্ব›দ্বী ক্রেডিট সুইসকে দেউলিয়ার হাত থেকে বাঁচাতেই অধিগ্রহণ করেছে। এ দুটি ব্যাংক মার্জার বা একীভূত হয়ে আর্থিক সংকট মোকাবেলা করবে। আর একীভূত হওয়া এ প্রক্রিয়া শেষ হতে এবছর লেগে যাবে। ঐতিহাসিক টেকওভার ঘোষণায় বলা হয়েছে, ইউবিএস গ্রæপ এবং ক্রেডিট সুইস গ্রæপ, ইউরোপীয় ব্যাংকিংয়ের দুটি বড় নাম, পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে এবং একটি বৈশ্বিক সংকট এড়ানোর লক্ষ্যে একটি চুক্তিতে একত্রিত হচ্ছে।
ইউবিএস এর আগে সুইস সরকারের কাছে ক্রেডিট সুইস অধিগ্রহণ করতে ৬ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। রোববার ইউবিএস ৩ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক (৩.২৪ বিলিয়ন ডলার) স্টক দিতে সম্মত হয়। এর বিনিময়ে সরকারি গ্যারান্টি এবং সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ বিলিয়ন ফ্রাঙ্ক তারল্য সহায়তা পাবে ইউবিএস। এখন ইউবিএসকে ক্রেডিট সুইসের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারে ক্ষতিকে মোকাবেলা করতে হবে।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লেগার্ড একীভ‚তকরণ সম্পর্কে বলেছেন, আমি সুইস কর্তৃপক্ষের দ্রæত পদক্ষেপ এবং গৃহীত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তারা সুশৃঙ্খল বাজার পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সহায়ক। যদিও এই অঞ্চলের ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল রয়েছে। আমাদের নীতি টুলকিটটি প্রয়োজন হলে ইউরো অঞ্চলের আর্থিক ব্যবস্থায় তারল্য সহায়তা প্রদান করতে এবং মুদ্রানীতির মসৃণ গতিশীলতা সংরক্ষণের জন্য সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা যেতে পারে।
চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের পতনের পর তা অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলে। ক্রেডিট সুইস গত মাসে ২০২২ সালে ৭.৩ বিলিয়ন ফ্রাঙ্কের নেট লোকসানের কথা জানায়। এও জানায় আগামী বছর লাভজনক অবস্থায় ফিরে আসার আগে এটি এবছর আরও একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষতির মুখে পড়বে। গত সপ্তাহে গ্রাহকরা ক্রেডিট সুইস থেকে অন্তত ৫০ বিলিয়ন ফ্রাঙ্ক তুলে নেয়।
ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইস সংযুক্ত হওয়ার পর এ দুটি ব্যাংকের সম্মিরিত বিনিয়োগকৃত সম্পদের পরিমান ৫ ট্রিলিয়ন ডলারেও বেশি। ইউবিএস চেয়ারম্যান কলম কেলেহার সুইজারল্যান্ডের বার্নে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন যে অধিগ্রহণের পর এটিকে সফল করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এটি সুইজারল্যান্ডের আর্থিক কাঠামো এবং… বৈশ্বিক অর্থায়নের জন্য একেবারে অপরিহার্য। তাছাড়া এ উদ্যোগ আর্থিক স্থিতিশীলতা সুরক্ষিত করা ছাড়াও সুইস অর্থনীতিকে রক্ষা করবে। কেলেহার আরো বলেন, এ অধিগ্রহণ একটি জরুরি উদ্ধার এবং এর কোনো বিকল্প ছিল না।
সোমবার বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মন্দা রোধ করতে মরিয়া, সুইস কর্তৃপক্ষ সীমিত রাষ্ট্রীয় সহায়তার সাথে একটি বেসরকারী খাতের সমাধানের জন্য অনুসন্ধান শুরু করে, অধিগ্রহণের পাশাপাশি ক্রেডিট সুইসকে পূর্ণ বা আংশিক জাতীয়করণের কথাও ভাবা হয়েছিল। এধরনের শলা পরামর্শের পর সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে দেশটির অন্যতম ক্রেডিট সুইস ব্যাংক ও বৃহৎ ব্যাংক ইউবিএস-এর চেয়ারম্যান যারা এর আগে চির প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন তারা এখন সংকট মোকাবেলায় একত্রে কাজ করার ঘোষণা দিলেন। এক সপ্তাহজুড়ে হতাশায় নিমজ্জিত এবং একীভ‚তকরণ ক্রেডিট সুইসের মূল্য এখন প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ৩২০ কোটি ডলার। সেটি ইউবিএস এজি এখন ৩২৩ কোটি ডলারে কিনে নিচ্ছে। একই সঙ্গে ক্রেডিট সুইসের ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণের দায়ও নিচ্ছে ইউবিএস।
ইকোনমিস্ট বলছে, ১৬৭ বছরের পুরোনো ব্যাংক ক্রেডিট সুইস অস্তিত্ব হারালো। যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপের ব্যাংকগুলোতে বিপর্যয় ঘটতে থাকায় বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাও গোলযোগের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।
২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে উভয় ব্যাংকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময় ইউবিএস সুইস সরকারের কাছ থেকে বেল-আউট পেয়েছে। স¤প্রতি, তাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেছে। ইউবিএস-এর কর্তারা যখন জাহাজটিকে স্থির রাখার চেষ্টা করেছেন ক্রেডিট সুইস অনেক দুর্ঘটনার কারণে সে সময় নি¤œ স্তরে চলে গেছে।
গত বছর ক্রেডিট সুইস ব্যাংক ৭ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ লোকসান গুণে। ২০০৮ সালের পর এটি ছিল সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি। গত ৩ বছরে ক্রেডিট সুইসের শেয়ারের দাম ৭০ শতাংশ কমেছে। যেখানে ইউবিএসের শেয়ারের মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে। গত অক্টোবরে ক্রেডিট সুইসের কর্মকর্তারা তাদের বিনিয়োগ-ব্যাংকিং খাত থেকে খরচ কমাতে এবং পুঁজি পুনঃবন্টন করার যে পরিকল্পনা করে তা বাজারকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।
এসব ঘটনার জেরে এক সপ্তাহ আগেও খুব কম লোকই একটি টাই-আপের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু ১৫ মার্চ ক্রেডিট সুইসের শেয়ারের মূল্য এক চতুর্থাংশ কমে সর্বনি¤œ স্তরে পৌঁছায়। সৌদি ন্যাশনাল ব্যাংক, এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার। সৌদি ন্যাশনাল ব্যাংক নতুন ফান্ড দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর গত বুধবার একদিনেই শেয়ারের ৩০ শতাংশ দর পতন ঘটে ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের। ১৬ মার্চের প্রথম দিকে, ক্রেডিট সুইস জানায়, এটি তারল্য বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নেবে।
১৬ মার্চের প্রথম দিকে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ব্যাংকটিকে ৫০ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আমানতকারীদের এবং বাজারকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল। এটিই যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল।কিন্তু আশ্রয় কোটরে কোনো শেয়ারহোল্ডার নেই। আমানতকারীরা তাদের নগদ টাকা তুলে নিচ্ছেন। ফলে বিপর্যয়ের মুখে সুইস কর্মকর্তারা অধিগ্রহণের জন্য সরকারকে চাপ দেয়।
ইউবিএস এখন পরিকল্পনা করছে, ক্রেডিট সুইসের বিনিয়োগ ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার। তাহলে তারা আশাবাদী যে ২০২৭ সালের মধ্যে তারা ব্যয় কমাত পারবেন ৭০০ কোটি ডলার। সুইস নিয়ন্ত্রকদের এই জাতীয় পরিকল্পনা কার্যকর করা বিশেষভাবে কঠিন হবে।
এক সপ্তাহ আগেও ক্রেডিট সুইস একটি সংস্কারমূলক, লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ব্যাংকের সম্পদ-ব্যবস্থাপনা ও সুইস ব্যাংকিং কার্যক্রমের সমন্বয় আশা জাগাচ্ছে। একীভ‚ত হওয়ার পর দুটি বিভাগই হবে পাওয়ার হাউস। ইউবিএস সম্ভবত সুইস দেশীয় বাজারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। একীভ‚ত ফার্মের বিনিয়োগ ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি খরচ কমানো হবে। ফলে এর বেশিরভাগই ক্রেডিট সুইসের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ে দৃঢ়ভাবে সম্পদ ব্যবস্থাপনার অধীনে রাখার অঙ্গীকারের অর্থ হলো প্রচুর ছাঁটাই চলবে। আপত্তিকর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসাগুলোকে একটি নন-কোর ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হবে এবং দ্রæত বিক্রি করা হবে।
বিশ্বজুড়ে আর্থিক নীতিনির্ধারকরা নতুন প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের জন্য আগ্রহী হবেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অশান্তি যেখানে তাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯ মার্চ ফেডারেল রিজার্ভ ও অন্যান্য পাঁচটি ধনী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিলে বাজারের ওপর চাপ কমানোর প্রয়াসে ডলারের তারল্য বাড়ানোর ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে।
তবে সুইস কর্মকর্তারা একটি সুস্থ ইউনিয়নের জন্য সবার চেয়ে আগ্রহী হবেন। ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইসের সম্মিলিত সম্পদ সুইস জিডিপির প্রায় দ্বিগুণ হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মেগা ব্যাংকের গুরুত্বের কারণে নিয়ন্ত্রকরা উচ্চ মূলধন অনুপাতের ওপর জোর দেবে। এ ধরনের চুক্তির ফলে নতুন প্রতিষ্ঠানটির আকারও খুব বড় হবে।