অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থনীবিদরা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, আর্থিক খাতের সংস্কার ও বৈষম্য কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ
সোহেল রহমান : সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হলে কোভিডকালীন গৃহীত প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আগামী বাজেটে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা জরুরি। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতায় ফাইন্যান্স কমিশন বা ব্যাংক কমিশন গঠন এবং বৈষম্য কমাতে সম্পদ কর চালু ও ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা প্রয়োজন।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল-এর সঙ্গে গত রোববার এক ভার্চুয়াল প্রাক্-বাজেট আলোচনায় দেশের অর্থনীতিবিদরা এসব সুপারিশ করেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
বৈঠকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে আগামী বাজেটে কর কমিশন গঠন এবং খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সকল ভোগ্যপণ্যের জন্য প্রাইসিং পলিসি প্রণয়নেরও পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিপি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দারিদ্র হ্রাস ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা থাকলেও বৈষম্য বাড়ছে। সরকারের অনেক নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈষম্য বাড়াতে সহায়ক ভ‚মিকা রাখছে। প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ কর আহরণে গুরুত্ব দেয়াও এমন একটি কারণ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্ভ্রান্তরাই শুধু কোয়ালিটি শিক্ষা পাচ্ছে। একই অবস্থা স্বাস্থ্যখাতেও। তাই পাবলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে বাজেটে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ, এটি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এটা ম্যাক্রো-ইকোনমির ক্রেডিবিলিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইমেজ ও ইনভেস্টমেন্ট পলিসির সঙ্গে সম্পৃক্ত। খেলাপি ঋণের সঙ্গে বাজারের কিছু বড় প্লেয়ার সম্পৃক্ত। পুনঃতফসিল ও রাইট-অফ সুবিধা দিয়ে রিসোর্সগুলোকে খেলাপিদের হাতে দেয়া হচ্ছে। অথচ ব্যাংকের অর্থ আমানতকারীদের মধ্যে অনেকেই দরিদ্র। ঋণ খেলাপির সুবিধা দেয়াও সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। সব সরকারই বলে থাকে যে, ঋণ খেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু সব নির্বাচনের আগে ২%-৫% ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হতে সহায়তা করা হয়।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, একটি সমস্যার সমাধান হলেই অর্থনীতির সব সমস্যা দূর হয়ে যায়, তা হলো- কর-জিডিপি বাড়ানো। তাই বাজেটে এদিকে মনোযোগ দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, বড় ঋণ খেলাপি কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণকে আগামী অর্থবছর ইক্যুইটিতে রূপান্তর করে সরকার এগুলোর মালিকানা নিয়ে নিতে পারে। আর্থিক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করতে ১৯৮১-৮২ সালে যেভাবে মানি অ্যান্ড ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়েছিল, এখনও তেমন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এতে অন্তত সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে। পরে সরকার সমস্যা সমাধান করবে কি-না, সেটি বিবেচনা করতে পারে।
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে আগামী বাজেটে সীমিত পরিমাণে হলেও সম্পদ কর চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অন্তত মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এটি চালু করা যেতে পারে। গ্রামে মানবসম্পদ ও পুষ্টিসূচকের উন্নতি ঘটলেও নগরের দরিদ্র ২০% জনগোষ্ঠীর কোন উন্নতি হচ্ছে না। নগর দরিদ্রের দিকে বাজেটে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটর (পিআরআই)-এর চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, আগামী বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একই সঙ্গে রাজস্ব, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়াতে হবে।
পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, ডলার সংকট দূর করার উদ্যোগ থাকতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ডলার সংকট সমাধানের উপায় হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ঠিক না। সরকার অনেক জায়গায় ব্যয় কমাতে পারে। এডিপি-তে এতো ১,৫০০ প্রকল্প কেন? মোটা চাল সরুকরণ প্রকল্প নেয়া হয়। এগুলো তো বেসরকারি খাতের কাজ।
বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী সাহাবুদ্দিন বলেন, , ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকার যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তার বর্ণনাসহ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেটে কী পদক্ষেপ থাকছে, তার একটি বিবরণ বাজেট থাকা দরকার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ম্যাক্রো ইকোনমি স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কোভিডকালীন সময় থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, যা দূর করতে আগামী বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডে ব্যাংক ধস নতুন করে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সংকেত দিচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।