উন্নত সংস্কৃতি ছাড়া উন্নত রাজনীতি আসবে না
মুজিব রহমান
যারা দক্ষিণ ভারতের বাহুবলী, কেজিএফ, আরআরআর ও পুষ্পা এর মতো সিনেমা দেখে ভাবেন এমন একটি সিনেমা কেন এদেশে নির্মিত হয় না; তাদের জন্য বলি, এই ক্ষমতাটাই আমাদের অর্জিত হয়নি। নাটু নাটু গানটি অনেক বারই দেখেছি। কি অসাধারণ নির্মাণ! মুগ্ধ হতে হয় এর কস্টিউম, ছন্দ, নৃত্য, সংগীত দেখে— একটা পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ। এটা নির্মাণ করতে হলে ক্ষমতা লাগে। এই ক্ষমতাটা হল যোগ্যতা। নাটু নাটু গানের চেয়ে এদেশে অনেক বেশি জনপ্রিয় হিরু আলম। হিরু আলম একটি অযোগ্যতার আকর। সর্ব বিষয়ে অযোগ্যতাই হিরু আলমের যোগ্যতা। এটা আমাদের সংস্কৃতিতে আছে। যখন কেউ বহুমাত্রিক অযোগ্য হয় তখন তাকে অনেক উপরে উঠিয়ে দেয়। নির্বোধ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের অনেকেই আধ্যাত্মিক বাবা হয়ে উঠেন। তাদের সরল জীবন দেখে অনেকে বিমোহিত হন, সাধু জ্ঞানে সঙ্গলাভ করেন। অনেক সময় এদের নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিজয়ী করে আনারও অনেক নজির রয়েছে। সিলেটে ছক্কা ছয়ফর নামে একজন ছিলেন। তাকে লোকেরা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে ফেলেছিলেন। অযোগ্যদের প্রতি আমাদের আকর্ষণ আমাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে প্রবলভাবেই। অনেকে এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারেন। একটি ভাল কবিতা পোস্ট দিলে দেখা যায় ১০০ লাইক পড়েনি কিন্তু এটা অহরহই দেখা যায় খুবই নি¤œমানের একটি কবিতা ১০০০ লাইক পেয়েছে। এটা হয় এক নির্বোধ আরেক নির্বোধকে পছন্দ করার কারণে। নির্বোধের সংখ্যা বিপুল হলে, তাদের নির্বোধ পছন্দও বিপুল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের মানুষ অধিকাংশই দরিদ্র। অনেকে উদয়াস্থ পরিশ্রম করে। তাদের জ্ঞান ও ভাল সংস্কৃতির চর্চা করার সময়ও নেই। অধিকাংশ তরুণই হতাশাগ্রস্থ! এদেশে জ্ঞান চর্চার অনুশীলন একেবারেই হয় না। কোন বিষয় নিয়ে মত প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে কেউই যুক্তি দিতে এগিয়ে আসে না। তারা লাঠি নিয়ে আসতে চায়। বিতর্ক তারা বুঝেও না, করেও না। কেন করে না? কারণ তাদের সেই ক্ষমতাটা নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সাহিত্য চর্চার জন্য দরকার অফুরন্ত অবসর’। সেই অবসর রবীন্দ্রনাথের ছিল বটে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল না বলে তিনি অকালে মরেছেন। জীবনানন্দ দাশও কলকাতার ট্রামের তলায় চাপা পড়ে বা আত্মহত্যা করে জীবন উৎসর্গ করেছেন, আর্থিক দৈন্যতার কারণেই। যে নজরুল বিদ্রোহীর মতো কবিতা লিখতে পারেন, সেই নজরুলকেও ছুটতে হতো অর্থ আয়ের জন্য। তিনিও লিখতে পেরেছেন অল্প কদিনই। এথেন্সে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষের পেছনে এই অবসর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। সক্রেটিস সারাজীবনেও কিছু করেননি সংসার চালানোর জন্য। তার পারিবারিক কিছু আয় ছিল যা দিয়ে ভালমতো সংসার চলতো না বটে, তবে চলে যেতো। সেখানে ছিল কাজ করার জন্য নাগরিকদের চেয়েও বেশি দাস। দাস মালিকদের অনেকেরই কিছু করে খেতে হতো না। কেউ কেউ দাস পরিচালনাতেও নিয়োজিত থাকতেন না। এতো অবসর তাদের মধ্যে গণতন্ত্র এনে দিয়েছে, দর্শন এনেছে, বিজ্ঞান এনেছে, সাহিত্য এনেছে। বাস্তবিক সেখানে একটি উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।
আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত কথা হল— ‘শিক্ষিত মানুষই বেশি খারাপ?’ এই ভাবাদর্শ একটা সংস্কৃতি! যারা এমনটা বলেন তাদের অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছি, ‘কেন খারাপ?’ দুই ধরনের উত্তর পাই- ১) শিক্ষিত মানুষরাই বেশি ঘুস দুর্নীীততে নিমজ্জিত, ২) শিক্ষিত হলে মানুষ ধর্ম-কর্ম মানে না। প্রথম অভিযোগকে সত্য বলা যায় না একেবারেই। আমাদের সংস্কৃতিতে দুর্নীতিকে মন্দ হিসেবে দেখা হয় না। কোন দুর্নীতিবাজকেই মানুষ নিন্দা করে না। বরং তাকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয় বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। আমরা দেখি সিটি কর্পোরেশনের পিয়ন, ডেসা মিটার রিডার, হাসাপাতালের গাড়ি চালকও দুর্নীতি করে বহু সম্পদের মালিক হয়ে যান। তারা অল্প শিক্ষিত। বিষয় হল, বেশি শিক্ষিত হলে দুর্নীতি করার সুযোগও বেশি থাকে। এরপরেও উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই কিছু সৎ মানুষ পাওয়া যাবে। বরং তুলনামূলকভাবে চাকরির ক্ষেত্রে কম শিক্ষিত মানুষই গড়ে অধিক সংখ্যায় বা আনুপাতিক হারে অধিক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকে। আমি ১২টি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। নিচের লেভেলে সৎ লোক পাওয়া দুষ্কর। কারণ তারা দুর্নীতি বুঝে না, বুঝে বাড়তি আয় করতে হবে। এটাকে অপরাধ হিসেবে তারা জ্ঞানই করে না। দ্বিতীয় অভিযোগ সত্য যে, উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেই বেশির ভাগ নাস্তিক বা ধর্ম অবিশ্বাসী। পরিবার ও সামাজিক ভাবে ধর্ম খুবই প্রভাবশালী অবস্থায় রয়েছে। ফলে মেধার বিকাশ না ঘটলে এই প্রভাব কাটিয়ে অবিশ্বাসী হওয়া অসম্ভবই। এটা কেবলমাত্র উচ্চ শিক্ষিতদের পক্ষেই সম্ভব।
এদেশে অসংখ্য বাচ্চা ছেলে বলাৎকারের শিকার হয়। সাধারণত মানুষ শুনে মুচকি হেসে সটকে পড়ে। বলাৎকারকারীর গণপিটুনির শিকার হতে দেখাই যায় না। কিন্তু চোর বা ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা অহরহই ঘটে। হত্যার পরে দেখা যায় তারা নির্দোষ ছিলেন। আমাদের এলাকায় একজন ক্রমিক ধর্ষক একজন গর্ভবতী নারীকে ধর্ষণ করলে ওই নারীর এবর্সন ঘটে যায়। দুদিন পরেই দেখলাম বুক ফুলিয়ে যাচ্ছে? আমার বন্ধু সুশীল তাকে বলল, ভাই এটা কি করলেন? ওনি বললেন, ‘করার জিনিসই করছি!’ কদিন পরে দেখলাম ওনার স্বামীকে চাপ দিয়ে ডিভোর্স করানো হয়েছে। ওই মহিলার পৈতৃক বাড়ি ছিল অন্য জেলায়। ধাপাচাপা পড়ে গেল সব। আরো শৈশবে দেখা একটি ভয়ানক দৃশ্যের কথা মনে আছে। আমাদের বাড়ির কাছে পোস্ট অফিসের পুকুরে একজন নারী এসেছিলেন কলস ভরে পানি নিতে। সে তার স্বামীর ঘর করবে না বলে বাপের বাড়িতে থাকছিল। স্বামী ওই নারীর চুলের মুঠি ধরে হিচরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। সে অনবরত কাঁদছিল। প্রথমে ঘাটলার বাঁশ এরপর আশে-পাশের গাছগাছড়া ধরে টিকে থাকার চেষ্টা করছিল। কেউ এগিয়ে আসলো না ওই নারীকে রক্ষা করতে। রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় টেনে নিয়ে গেল শতশত মানুষের সামনা দিয়ে। এর কিছুকাল পরে একজন নারী তার মাকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি নাকি যৌনকর্মী ছিলেন? তাঁকে ধরে আনা হল বাজারে জনকল্যাণ মাঠে। তার চুল কেটে মুখে চুনকালি মাখিয়ে বাজার ঘোরানো হয়। অথচ এরাও নিয়মিত পতিতালয়ে যেতো। নারী নিপিড়ন ও যৌন হয়রানীকে এখনো অনেকে অপরাধজ্ঞান করেন না। গৃহে নারী নিপীড়নে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন এখন।
আমাদের এলাকায় খুব জনপ্রিয় এক তরুণের কাছে জানতে চাইলাম, ‘এখনো কি স্বর্ণ পাচারই করো?’ সে জানালো, ‘এটা এখন কম করি? অনেক বিনিয়োগে লাভ কম আবার ঝুঁকি বেশি। হংকং থেকে এনে কলকাতা পৌঁছে দিতাম। এখন চীন থেকে ক্যান্সারের ওষুধ আনি ১২/- করে দাম পড়ে, বিক্রি করি ৩০০০/- টাকা করে।’ এলাকার সবাই জানতো কিন্তু এ নিয়ে কারো কোন সমস্যা বা আপত্তি নেই? প্রভাবশালীদের সে বিভিন্ন সময়ে টাকা পয়সা দিয়ে খুশি রাখতো। তার ছেলের মুসলমানিতে মেহমান ছিল ১৫ হাজার!
এক সাংবাদিক বন্ধুর প্রস্তাবে হৈহৈ করে রাজি হলাম? ২৬ মার্চ এক মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দিবো। বিরাট আয়োজন। আপ্যায়নও আছে। অতিথিও অনেক। দর্শকদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। আমি উপস্থাপক। এর মধ্যে স্নেহভাজন ঞধঢ়ধংয উধং এসে বলল, ভাই ওতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর দেশের সবচেয়ে বড় ওষুধ ভেজালকারী? আমরা দুজন পালিয়ে গেলাম? পরে শুনেছি ওনি সেই আমলে লাখ টাকা দিয়েছিল অনুষ্ঠানটি করার জন্য। শ্রীনগর হল দেশের কজন শীর্ষ ওষুধ জালিয়াতকারীর বাড়ি। শুধু টাকার জোরে আমরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখেছি। সবাই জানে কিন্তু এসবকে সাদরে মেনে নেয়ার একটা সংস্কৃতিও আমাদের আছে। এসব সংস্কৃতি রেখে উন্নত রাজনীতি আনতে পারবেন না।