আড়ালে হাসি দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য দাত
ওয়াসি মাহিন: যুগ যুগ ধরে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এর সাহায্য নিয়ে চলছে উন্নতির আশা করা গরিব দেশগুলি। এসব দেশের উপর ঋণদাতাদের খবরদারির নিউজগুলি আড়ালে থাকলেও বিকল্প হিসাবে চীনের ঋণ যখন এসব দেশগুলি নেয়া শুরু করেছে তখন তাদের সকলকে ঋণ ফাঁদে ফেলা অথবা চীনের দখলে চলে যাওয়ার খবর প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসাবে প্রচার হয়েছে। অন্তত পক্ষে মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সত্য যেটাকে বলে। কেউ একবারো বলছে না কোন ঋণ বা কার ঋণ শোধ দিতে গিয়ে কোন দেশ দেউলিয়া হচ্ছে। কেউ বলছেনা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বন্ড ইস্যু করে, উচ্চ সুদে মার্কেট বরোয়িং করে কোন দেশগুলি বিপদে পড়েছে। সব দোষ আসলে চীনের। আড়ালে হাসি দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য দাতারা। আচ্ছা কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে, যেটা আপনি ঋণ হিসাবে নিয়েছেন এবং পরিশোধের শর্ত রয়েছে, সেই ঋণকে পশ্চিমা মিডিয়া, দেশি মিডিয়াসহ সবাই বলে ‘এইড’/ সহায়তা। যেটা ঋণ সেটাকে এইড বা সাহায্য বলার বিরুদ্ধে কাউকে প্রতিবাদ করতে শুনেছেন? গ্রান্ট বা অনুদান অর্থাৎ যেটা ফেরত দেয়া লাগেনা সেটাকে এইড বললে সমস্যা নেই। কিন্তু ঋণকে এইড বলে ক্রেডিট নেয়া ফেরেশতা সাজা দেশ বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারো যেন কিছুই বলার নেই। প্রতিবাদের কথা তো দূরের কথা। ২০২২ সালের কথা। জুলাই মাসের কোন এক সকালের কথা। সকালে ফেসবুকে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম। বন্ধুর মেসেজ। ঢুকে দেখি বøæমবার্গের একটা নিউজের লিঙ্ক নিউজটির হেডলাইন “ইধহমষধফবংয ঝববশরহম ওগঋ ইধরষড়ঁঃ ধং ওঃং ঋঢ জবংবৎাবং ঋধষষ, ঝড়ঁৎপবং ঝধু” লিখেছেন অৎঁহ উবনহধঃয। হতবাক হয়ে নিউজের ভেতরে ঢুকে দেখলাম বেইল আউট / জামিন শব্দটির কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু কি ভয়ঙ্কর একটি শিরোনাম। একজন বাংলাদেশি হিসাবে অর্থনীতির নিয়মিত আপডেট রাখা আমার অভ্যাস। হুজুগে অভ্যাস না। বিগত প্রায় এক যুগ ধরে কাজটা করি। নিজের দেশকে জানার তিব্র ইচ্ছা থেকে অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বøæমবার্গের শিরোনাম দেখে খুব অপমানবোধ কাজ করেছে। কারণ বøæমবার্গের খবর সারাবিশ্বের কাছে বার্তা দিচ্ছে যে বাংলাদেশ দেউলিয়া হবার দ্বার প্রান্তে! কি ভয়ঙ্করভাবে নিজের দেশকে বøæমবার্গ এভাবে হেয় করল। বিষয়টা পরিস্কার করা দরকার। শুরুতে জানা দরকার বেইল আউট কি? যখন কোন দেশ তার ঋণ পরিশোধে ব্যার্থতার দারপ্রান্তে তখন ইমার্জেন্সি ভাবে ঋণ পরিশোধে ব্যার্থতা এড়াতে আইএমএফ এর কাছে হাত পাততে হয়। আইএমএফ বিভিণœ শর্ত দেয়। দীর্ঘ আলোচনা হয়। যদি আইএমএফ খুশী হয় তখন তাদের ফান্ড ছাড় করে। বলতে পারেন লোন ডিফল্ট করার হাত থেকে বাঁচার সর্বশেষ পর্যায়ে বেইল আউট প্যাকেজ নেয়া হয়। বেইল আউট নেয়াটা একটা দেশের জন্য বেশ লজ্জার বিষয়। বিকল্প উপায় না থাকলে সর্বশেষ আত্মসমর্পণ করে বেইল আউট প্যাকেজের আবেদন করা হয়।
উল্লেখ্য, আইএমএফ এর ঋণ মানেই বেইল আউট নয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আইএমএফ এর ফান্ড ব্যাবহার করেছে। এবার বাংলাদেশ আইএমএফ এর কাছে মোট ৪.৫ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে। মূলত ক্রেডিটরস জবংরষরবহপব ধহফ ঝঁংঃধরহধনরষরঃু ঞৎঁংঃ (জঝঞ) ফা থেকে ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ এর এশিয়া প্যাসিফিকের ডিরেক্টর কৃষনা শ্রীনিভাসন নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। এই ফান্ড দেয়া হয় সাইটেইনেবল গ্রোথ নিশ্চিত করবার জন্য। হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ তার স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস এর ১৫০% পর্যন্ত এই ঋণ নিতে পারে। অথচ বøæমবার্গের নিউজে স্পষ্ট বলে দেয়া হল বেইল আউট প্যাকেজ নিচ্ছে বাংলাদেশ। কি ভয়ঙ্কর অপমানজনক এই শিরোনাম সেটা বোধহয় অনেকেই বুঝবেন না। বিশ্বের কাছে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যত শেষ।
বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলির একটি ডেইলি স্টার। ঋণ নিয়ে বেশ ভীতিকর একটি শিরোনাম নজরে এলো। ২০৩০ সালে বাংলাদেশকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৫.১৫ বিলিয়ন ডলার। যাদের এই বিষয়ে খবর রাখার সময় নেই বা সুযোগ হয়না অথবা নিউজের ভেতরে পড়বারো অবকাশ হয়না তারাও চলমান সারাদেশে ঋণ নিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতিতে এরকম শিরোনাম দেখে ভয় পাবেন। নিউজের ভেতরের ঢুকে দেখলাম, গত মার্চ মাসে আইএমএফ উবনঃ ঝঁংঃধরহধনরষরঃু অংংবংংসবহঃ জবঢ়ড়ৎঃ প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তনাম উবনঃ এউচ জধঃরড় ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮.১% যেটা ২০৩১-৩২ অর্থবছরে কমে ১৩.৪% এ নেমে আসবে। অবকাঠামো প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছাবে ২০২৯-৩০ অর্থবছরে। এরপর এটা কমতে থাকবে। এভারেজ হিসাবে বাংলাদেশের ডেট জিডিপি রেশিও ১৮.৭% যেটা কমে ১৫.১% এ নামবে। সব মিলিয়ে আইএমএফ এর হিসাব অনুযায়ী ঋণ নিয়ে কমফোর্ট জোনে বাংলাদেশ। কিন্তু শিরোনাম দেখে শিউরে উঠবে অনেকেই।
গতকাল থেকে আরেকটি নিউজ পড়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ নাকি মাত্র ১৩ দিনের। আমার জানা মতে বাংলাদেশের তেল বা খাদ্য শস্য মজুদ করার মত উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা নেই। তেলের ক্ষেত্রে ৪৫ দিনের মজুদ ক্ষমতা আছে বলে জানতাম। বিগত কোভিড সময়ে অর্থাৎ ২০২০ সালে বিশ্ব বাজারে যখন তেলের দাম $৩০ ডলারে নেমে আসে তখনো লিখেছি বাংলাদেশের মজুদ ক্ষমতা বেশি থাকলে এই প্রাইস কমার সুযোগ কাজে লাগাতে পারত যেটা ভবিষ্যতে বিরুপ পরিস্থিতিতে আমাদের মূল্যবাদ অর্থের সাশ্রয় করতে পারত। এই ইস্যুতে বিগত কয়েক বছর লাগাতার লিখে গেছি। গরিবের কথা কে শুনবে? কিন্তু ১৩ দিনের মজুদ শুনে ঘাবড়ানো যে কারো জন্য স্বাভাবিক।
পরে জানা গেল, দেশে ডিজেলের মজুদ ক্ষমতা ৬ লাখ মেট্রিক টনের মত। অকটেন মজুদ ক্ষমতা ৪৬ হাজার মেট্রিক টন, পেট্রল ৩২ হাজার মেট্রিক টন, কেরোসিন ৪২ হাজার মেট্রিক টন এবং ফার্নেস অয়েল ১.৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে ডিজেলের মজুদ আছে ৪ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন, ফার্নেস অয়েল প্রায় ৮২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। অকটেন মজুদ আছে ১৪ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন, জেড ফুয়েল ৫৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন, পেট্রল প্রায় ১৭ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন এবং কেরোসিন আছে ১৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। আগামী ৬ মাসের জ্বালানির বুকিং দেয়া রয়েছে। সমস্যা হল, বাংলাদেশে যখন কোন ইস্যু নিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করা যায় তখন এক পক্ষের লাভ হয়। বিদেশে টাকা পাচার বাড়ে। দুর্বল দেশ যত দুর্বল হবে অথবা যত দুর্বল প্রমাণ করা যাবে তত দুর্বল দেশগুলি থেকে উন্নত দেশগুলিতে টাকা পাচার বাড়বে। দেশ নিয়ে হতাশা সৃষ্টি করার এটা একটা বড় লাভ এক পক্ষের কাছে। আবার তারাই বড় বড় দাতা দেশের নামে সাহায্যের মোড়কে ঋণ দিবে। আমজনতা আমরা এসব বুঝিনা। ভাবিও না। মিডিয়াতে যা আসবে আমরা সেটা নিয়েই মারামারি কাটাকাটিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ব। সবথেকে লস হবে সেসব মানুষদের যারা ঋণ কি, অর্থনীতি কি এসব বুঝার সময় নেই। দিন আনে দিন খায়। আমরা যতটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করব এবং ভাবব যে আমরা মনে হয় জিতে গেলাম, ততটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই দেশ। মিডিয়ার দায়িত্বশীল হবার বিকল্প নেই। আমাদের শুভ বুদ্ধির উভয় হোক।
া