
সিলেটে দৃশ্যমান হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির স্মার্ট কৃষি

মতিনুজ্জামান মিটু: হতাসা থেকে বেরিয়ে নতুন আশার আলো জ্বালতে শুরু করেছেন সিলেটের মানুষ। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃশ্যমান হচ্ছে বদলে যাওয়ার এচিত্র। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণে এখানকার কৃষকের চোখে মুখে ফুটে উঠছে হাসির রেখা। চাষের আওতায় আসছে অনাবাদী পতিত জমি। মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণামতে প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগাতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এখানে বাস্তবায়ন করছে এক যাদুকরি প্রকল্প।
প্রকল্পটির পরিচালক কৃষিবিদ মো. রকিব উদ্দিন ও মনিটরিং অফিসার কৃষিবিদ আবদুল মান্নান জানান, বিশ্বখ্যাত হাকালুকি টাঙ্গুয়ার হাওড়কে বুকে ধারণ করেও প্রকৃতির বিচিত্র লীলাভুমি সিলেট দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। বৈচিত্রময় ভূপ্রকৃতির সিলেটকে হাতছানী দেয় এখানকার হাওড়, বাঁওড়, বিল, পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল আর সমতলভুমির যুথবদ্ধতা।
সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ নিয়ে গঠিত এবিভাগের মোট আয়তন ১২,৫০৫ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১২ শতাংশ। এখানকার মোট এক কোটি ১৪ লাখ ২৪ হাজার ২০ জন মানুষের ১১ লাখ ৮১ হাজার ২১৩টি কৃষি পরিবারের হাতে ফসলী জমি রয়েছে ১২ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫৭ হেক্টর।
ভূমির বিচিত্র লীলায় রয়েছে হাজারও পাহাড়-টিলা। আরও বৈচিত্রময় করে তুলেছে এখানকার ২২৮টি হাওড়-বাওড়। সিলেটের আবাদি জমির ৪০ভাগই জলাভূমি। যেখানে রয়েছে বহু ছোট বড় হাওড়, বিল আর প্রকৃতিক জলাধার।
এদেশের ১৬৩টি চা বাগানের ১২৭টিই রয়েছে হযরত শাহ জালাল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি স্মৃতি বিজড়িত সিলেট বিভাগে। দানাদার খাদ্য শস্যতে এগিয়ে থাকলেও অনেক পিছিয়ে শাকসবজি উৎপাদনে। কৃষি পরিবেশ অঞ্চলেও রয়েছে বিচিত্রতা। জেড ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৯ ও ৩০ ভূক্ত মোট ৬টি পরিবেশ অঞ্চল নিয়ে সেজেছে এবৈচিত্রতা।
সিলেট জেলা ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত এজেলা ঢাকা বিভাগের আওতায় ছিল। ওই বছরই সিলেটকে নতুনসৃষ্ট আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ৪টি নতুন জেলায় বিভক্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে সিলেট জেলাসহ বৃহত্তর সিলেটের অপর তিন জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের আওতায় ছিলও। ১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ৪ টি জেলা (সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ) নিয়ে পৃথক সিলেট বিভাগ যাত্রা শুরু করে।
সিলেট অন্যন্য অঞ্চল থেকে আলাদা। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাংশে হাওর, বাঁওড়, বিল, পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল আর সমতল ভূমির অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত সিলেট অঞ্চল। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলার সমন্বয়ে এসিলেট অঞ্চল। অঞ্চলটির মোট আয়তন ১২,৫০৫.৩২ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যা ১,১৪,২৪,৭২০ জন। ১১,৮১,২১৩টি কৃষি পরিবারের মোট ফসলি জমি প্রায় ১২,৫৬,৮৫৭ হেক্টর। ভূমির বিচিত্র লীলায় রয়েছে হাজারও পাহাড়-টিলা এবং হাওর-বাঁওড়ের সংখ্যা প্রায় ২১৮টি। এঅঞ্চলে আবাদি জমির শতকরা ৪০ ভাগই হাওর এলাকা। যেখানে রয়েছে ছোট বড় হাওর, বিল আর প্রাকৃতিক জলাধার। বিশ্ব খ্যাত হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর এ সিলেট অঞ্চলেই অবস্থিত। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১২৭টি রয়েছে এসিলেট অঞ্চলে। শস্য ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ অঞ্চল শাকসবজি উৎপাদনে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখনও অনেক পিছিয়ে। কৃষি পরিবেশ অঞ্চলেরও রয়েছে এক বিচিত্রতা মোট ৬টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল যথা এইজেড ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৯ এবং ৩০ ভুক্ত এ অঞ্চল।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের যুগোপযোগী নীতিতে বাংলাদেশের কৃষি আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে রোলমডেল হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বাড়াতে নতুন উদ্ভাবিত ও সমসাময়িক আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সিলেট অঞ্চলে আধুনিক কৃষির রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে।
সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভী বাজার ও হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যা, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, নিম্ম তাপ মাত্রাসহ বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আধুনিক কৃষির প্রচলন তুলনামুলক ভাবে কম। তাই এঅঞ্চলে কৃষির উন্নয়ন আশানুরুপ হয়নি। অপ্রতুল সেচ সুবিধা, শ্রমিকের স্বল্পতা, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, প্রবাসী ভুমি মালিকদের হাতে চাষের জমির মালিকানাসহ নানা কারণে এঅঞ্চলের অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মৌসুমে বিশেষ করে রবি মৌসুমে পতিত থাকে। ফলে, এঅঞ্চলে শস্য নিবিড়তা (১৬৪.৩০শতাংশ) জাতীয় গড় শস্য নিবিড়তা (২১৫ শতাংশ) চেয়ে অনেক কম। এপ্রেক্ষাপটে আবাদ যোগ্য অনাবাদী পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা ও প্রধানমন্ত্রী’র ঘোষণামতে, দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগাতে হবে, কোন জমি পতিত ফেলে রাখা যাবে না। এলক্ষ্যেই ২০,০৫৪.৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদী ‘আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২২ সালের জুলাই মাসে। এপ্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগে গত খরিপ-২ এবং রোরো মৌসুমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আনাবাদি জমি আবাদের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া সিলেট অঞ্চলের প্রকল্পের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি মাঠে বাস্তবায়নে ৭১২৭৮ হেক্টর আবাদযোগ্য পতিত জমি জুন ২০২৬ এর মধ্যে আবাদের আওতায় আসবে।
এপ্রকল্প প্রান্তিক কৃষি ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। গত ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ সালে কৃষকের মাঝে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের জন্য কৃষি ঋণ মেলা আয়োজন করা হয়। মেলায় ৪২টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ৩৫৬জন কৃষকের মাঝে ২০৭.৩২ লাখ টাকা বিতরণ করে। গ্রামীণ দরিদ্র মহিলারা শাক-সবজি ও ফলচাষ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ করে আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারছেন। গ্রামীন নারী ও অক্ষম বা বঞ্চিত গোষ্ঠীর দারিদ্র দূরীকরণে এপ্রকল্প বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
প্রকল্পের আওতায় প্রতি ইউনিয়নে ৫টি কৃষিদল এবং পৌরসভায় ১ থেকে ৩টি করে দল মোট ১৭৭৭টি কৃষক দল গঠন করা হচ্ছে। প্রতি দলে ৩০ জন সদস্য। যাদের মধ্যে থাকছে কম পক্ষে ৩০শতাংশ মহিলা সদস্য। এছাড়াও ১২০টি কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমন, ১২০টি কৃষি মেলা, এবং প্রায় ৪৫০০ মাঠ দিবস তথা কৃষক সমাবেশ এর আয়োজন করে কৃষক সমাজকে বিভিন্ন ভাবে উদ্ধুদ্ধ করা। ইতোমধ্যে ৫৮৮টি দল গঠন এবং ২০টি মাঠ দিবস শেষ হয়েছে। নিরাপদ ও উচ্চমূল্যের সবজি-টমেটো, কেপসিকাম, ফল-তরমুজ, স্ট্রবেরী এবং ফুল-জাররেরা, গøাডিওলাস চাষের জন্য প্রতিটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প এলাকায় মোট ৪০টি পলিশেড হাউজ নির্মাণ কার্যক্রমের আওতায় ১৫টি পলিশেডের নির্মাণ শুরু হয়েছে। সেচ কাজে সহযোগিতার জন্য ৫০০ সেট এল এলপি (সেচযন্ত্র) বিতরণ করা হবে। ইতোমধ্যে ৩৩১ সেট বিতরন করা হয়েছে। এছাড়া ১৭৭৭ সেট হোস পাইপ, ১০০০ সেট পাওয়ার স্প্রেয়ার যন্ত্র, ১৭৭৭ সেট ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র এবং ৩৫৫৫৪ সেট স্প্রে মেশিন বিতরণ করা হবে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে রাজস্ব তহবিল হতে ১ (এক) লাক টাকা বরাদ্দ দিয়ে ৪৫ হাজার প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে সরিষা, সূর্যমুখী, ভুট্টা ও গম বীজ সরবরাহ করা হয়েছে।
