কিছু মানুষ নেতার পেছনে হাঁটতে পছন্দ করে এই দাসরা কোন ভাবেই নেতা হতে চায় না
মুজিব রহমান: দরিদ্র দেশের প্রায় সকল মানুষের মধ্যেই একটি দাস মনোবৃত্তি থাকে। তাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন বা ক্ষমতা থাকে না। এটা অবশ্য আদিকাল থেকেই দেখে আসছি। এথেন্স নগর রাষ্ট্রে অর্ধেকের বেশি ছিল দাস। তারাই ছিল কর্মঠ ও শক্তিশালী। যদি তাদের মধ্যে কেউ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতো তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও শক্তির জোরে ক্ষমতা অনায়াসেই দখল করে ফেলতে পারতো। রোমান সাম্রাজ্যে আমরা দাসবিদ্রোহ দেখেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই নেতৃত্ব ব্যর্থতার কারণেই চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। ভারতে একটি স্বল্পকালীন দাস রাজবংশ কায়েম হয়েছিল। মোহাম্মদ ঘুরির সেনাপতি ছিলেন দাস- কুতুবউদ্দিন আইবক। ঘুরির কোন সন্তান ছিল না এবং তিনি কয়েকজন দাসকে যুদ্ধে ও শাসনকার্যে পারদর্শী হিসেবে তৈরি করেছিলেন। সে কারণেই আইবক শাসক হতে পেরেছিলেন। মাত্র ৪ বছর শাসনের পরে মৃত্যুবরণ করার পরে শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ ও গিয়াসউদ্দিন বলবনও দাস হিসেবে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ঘুরির উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তিনি দাসদের তৈরি না করলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারতেন না।
অধিকাংশ মানুষেরই নেতা হওয়ার বাসনা থাকে না। ইতিহাসে অনেককে দেখলে মনে হয়, সম্ভবত নেতা হতে চাইলেই হওয়া যায়। এই চাওয়াটা ইচ্ছে করলেইতো হয় না। তার মধ্যে সাহস ও বিচক্ষণতাওতো থাকতে হবে। আবার ক্ষমতা স্পৃহাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি নেতা হতে চাই- এমন একটি ভাবাদর্শ তাকে অনেক দূরই এগিয়ে দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা একালে ডুনাল্ড ট্রাম্পকে দেখলাম, নেতা হতে চাইতে। তার রাষ্ট্র চালানোর যোগ্যতা ছিল না, বিচক্ষণতাও ছিল না তেমন কিন্তু স্পৃহাটা ছিল প্রকট। তিনি জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে ঠিকই রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। অবশ্য এমন নেতৃত্ব সচরাচর ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, সামরিক শক্তির সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। আফগানিস্তানে তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ধর্মকে ব্যবহার করে, ভারতের নরেন্দ্র মোদী হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে এবং হুমো এরশাদ সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসেছেন নিজেদের দেশ চালানোর যথেষ্ট যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্তে¡ও। তবে তাদের আমি সাহসীই বলি। যোগ্যতা না থাকার পরেও ক্ষমতালিপ্সা তাদের ক্ষমতার মসনদে পৌঁছে দিয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল তার ‘ক্ষমতা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যে সমাজে অভিজাততন্ত্র কিংবা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের মতো কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, সেখানে যারা অধিক ক্ষমতালিপ্সু তারাই ক্ষমতা অর্জন করে। সেখানে গড়পড়তা সাধারণ লোকদের চাইতে যাদের ক্ষমতাপ্রীতি বেশি তারাই ক্ষমতা দখল করতে পারে।’ রাসেলের এই পর্যবেক্ষণ আজকের দুনিয়াতেও লেগে যাচ্ছে। সাহসী মানুষের মধ্যে ক্ষমতাস্পৃহাকে বাড়িয়ে দেয়।
আমরা চেঙ্গিস খান বা কয়েকজন সফল ধর্মপ্রচারকের জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই তারা ক্ষমতা দখলের জন্য কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই না করেছেন। তারা বিভিন্ন বাধাকে অতিক্রম করেছেন এবং দৃঢ়ভাবেই নিজেকে টিকেই রেখেছেন প্রতিক‚লতায় এবং চাওয়াটাকে সফলতার দিকেই নিয়ে গিয়েছেন। এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের একটা মনোভাব রয়েছে। তারা সাতপাঁচে যেতে চায় না। হাঙ্গামা এড়িয়ে চলতে চায়। স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদে রাখতে পারলেই সুখবোধ করেন। তারা ক্ষমতায় যেতে চায় না আবার কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতেও প্রচেষ্টা চালায় না। তারা আশায় থাকে কেউ এসে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিবে। কিন্তু সমাজে দাস মনোবৃত্তি অধিক হলে, নতুনরা ক্ষমতায় এসেই পুরাতনের মতোই আচরণ করে। সে দেখতে চায় চারদিকে অসংখ্য অনুগত মানুষ। তাঁর আঙুল উত্তোলনে মানুষও উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে মানুষকে উদ্বেলিত হতে দেখেছি। ‘পারফিউম’ নামের একটি সিনেমা দেখেছিলাম। অসাধারণ সিনেমা। সেখানে নায়ক একটি স্পেশাল পারফিউম শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। সেই পারফিউমের আকর্ষণে মানুষ পাগল হয়ে উঠে। পারফিউম লাগিয়ে রুমাল দুলিয়ে মানুষকেও দোলাতে থাকেন। একসময় নিজের মাথায় সেই পারফিউম ঢেলে দেন। মানুষ তাকে সাবাড় করে দেয়। দাস মনোবৃত্তিটা এমন যে, সেখানে দাসরা নেতার প্রতি প্রচÐ আস্থা প্রদর্শন করে। নেতাই যেন সব। তার বিজয় মানে নিজের বিজয়। তার দোষের বিপরীতে নিজেই একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে নেয়। নেতার প্রতি তীব্রভাবেই অনুগত থাকে। মনে হবে, ‘নেতৃত্বের জাদু’, বাস্তবিক ঘটনা হল- দাস মনোবৃত্তির ফল এটা। কিছু মানুষ সর্বোচ্চ নেতার পেছনে হাঁটতেই পছন্দ করে কিন্তু কোন ভাবেই নেতা হতে চায় না। নেতাদের কাছেও তারা খুবই উপাদেয় খাদ্য। তারা খাদ্য হয়ে যাবে তবুও নেতার প্রতি আস্থা হারাবে না। এমনটা আমরা ওয়াজের বক্তার ক্ষেত্রেও দেখি। তাদের অনুরাগীরা নিজের স্ত্রী, কন্যাকেও দিতে পারে। বক্তা মামুনুল হকের ক্ষেত্রেও দেখলাম, তার দুই মুরিদই নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে প্রিয় হুজুরের জন্য ত্যাগ করেছে। কিন্তু তাদের মনে একবারের জন্যও প্রশ্ন জাগবে না, ‘হুজুর তার জন্য কি ত্যাগ করবে?’
এ ভ‚খÐে স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই আপনি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দেখেননি। একইভাবে একসময় ভারতজুড়ে ছিল বৌদ্ধ বিহার। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো। যখন বৌদ্ধ পাল শাসনের অবসান হচ্ছিল, বিভিন্ন বিহার দখলে নিচ্ছিল সেনরা তখন আমরা কোথাও প্রতিরোধ দেখিনি। আমরা গীর্জা, মন্দির প্যাগোডারও কোন প্রতিরোধ দেখিনি। সোমনাথ মন্দিরে ১৭ বার হানা দিয়ে লুণ্ঠন করে সুলতান মাহমুদ আর ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খলজি দখলে নেয় লক্ষণ সেনের রাজত্ব! কারণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করে অন্যের গলগ্রহ হয়ে। তাদের মধ্যে একটি দাসমনোবৃত্তি কাজ করে। হেফাজতের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি আমরা দেখলাম। একটা দৃশ্য সবাই দেখেছেন যে, তালবেলামরা কান ধরে সারিবদ্ধভাবে মতিঝিল ছেড়ে যাচ্ছে। ভেড়ারপালের সাথে মিল করতে পারবেন। হাজার হাজার ভেড়ার পালে একটি নেকড়ে অনায়াসেই ঢুকে একটি ভেড়াকে খেয়ে ফেলতে পারে। ভেড়ার মধ্যে রয়েছে দাসমনোবৃত্তি আর নেকড়ের মধ্যে সাহস। ভেড়ার মোট শক্তি বিশাল কিন্তু তারা পারে না। কতজন ব্রিটিশ ৩০ কোটি ভারতবাসীকে শাসন করতো? ভারতে অনায়াসেই আর্যরা ঢুকে যায় এবং তাদের দেবদেবীদের চাপিয়ে দেয়। বহিরাগত মুসলিমরাও অল্পই ছিল কিন্তু তারাও শুধু ক্ষমতাই দখল করেনি, দাসমনোবৃত্তির ভারতবাসীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে মুসলিম বানিয়ে ফেলে। স্থানীয় ধর্ম আর ভারতে বলিষ্ঠভাবে নেই। বৈদিক ও ইসলাম ধর্ম দুটিই বহিরাগত ধর্ম। পুরো ভারত ছিল কৃষি নির্ভর- জালিক আর হালিক; মানে জেলে আর হালচাষি! আর্য ও বহিরাগত মুসলিমরা ছিল যোদ্ধা। যেন ভেড়ার পালের উপর নেকড়ের হামলে পড়ার মতো ঘটনা ঘটলো!
আজকেও আমরা দেখি এদেশে একজন নেতার পেছনে শতে শতে লোক হাঁটে। কেউ কখনো একপেট খেতে পারে বা চা-বিস্কিটেই খুশি থাকে। নেতা এক পেট খেতে দিলে বিরাট কিছু। এই প্রবণতাটা আমরা পাশ্চাত্যে দেখি না। তারাও দলকে সমর্থন করে কিন্তু নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়-রোজগার ছেড়ে দিয়ে নেতার পেছনে পড়ে থাকে না। তারা ভোট দিতে আসে। আর নেতাকে লিফলেট নিয়ে দৌড়াতে বা পাড়ার মোড়ে হ্যান্ড মাইকে একা একা কথা বলতে দেখা যায়। আর আমাদের দেশে নেতা আসবেন বলেছেন সকাল ১০ টায়। ভেড়ার পাল কিন্তু অপেক্ষা করে থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই দেখবেন, প্রত্যেক নেতার সন্তানরাই কোটি কোটি টাকার মালিক। ইউটিউবে সার্চ দিন দেশের সেরা ১০ ধনী। এরমধ্যে নেতাদের ছেলেদের পেয়ে যাবেন যারা কিছু না করেও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশের কোন মানুষই কিন্তু প্রশ্ন করে না, ‘তিনি এতো টাকার মালিক কি করে হলেন? তার তো কোন কাজকর্ম নেই?’ দাস মনোবৃত্তির মানুষ এটা ভাবতেও পারে না। তারা খুশি হয় যে, তার নেতা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সেই টাকাও দেশে নেই। তাদের পাচার করার কারণেই দেশের মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও সুফলটা পায় না। এতো মানুষ নামমাত্র বেতনে গার্মেন্টে কাজ করে বা স্ত্রী-পরিজন ছেড়ে ঊষর মরুভ‚মিতে পড়ে থেকে অর্থ উপার্জন করে শেষ পর্যন্ত সুখের মুখ দেখে না। বহু প্রবাসীই তার সম্পদ হারিয়ে ফেলে কতিপয় দস্যুর কাছে।
দাস মনোবৃত্তি আত্মসম্মান নষ্ট করে দেয়। তাদের মধ্যে কর্মের স্পৃহাও নষ্ট করে। মানবাধিকার পাওয়ার দাবিও করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন ভোট না দিতে পারলেও কোন ক্ষোভ তৈরি হয় না। এদেশে দুর্ভিক্ষে প্রচুর লোক মারা যেতো। দেখা যেতো তখনও জমিদারদের গোলা ভরা ধান ছিল। কিন্তু সেই ধান ছিনিয়ে নেয়ার সাহস হতো না। ছিয়াত্তরের (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) দুর্ভিক্ষের আগে বাংলার মানুষ ছিল ৩ কোটি। দুর্ভিক্ষের পরে বেঁচে ছিল ২ কোটি মানুষ। মানে হল, এক কোটি মানুষ না খেয়ে মারা গেল! কিন্তু জমিদারদের গোলা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেনি। খাদ্যের সুষম বন্টন হলে সবাই বেঁচে থাকতে পারতো। পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) দুর্ভিক্ষে ব্রিটিশ সরকার জাপানিদের ভয়ে খাদ্য প্রত্যাহার করে নিলেও বাংলায় মোট খাদ্যের যে মজুদ ছিল তাতে ৩০ লক্ষ মানুষকে না খেয়ে মরার কথা নয়। তখনও বাজারগুলোতেও মজুদদারদের কাছে প্রচুর চাল ছিল। কিন্তু মানুষের কাছে টাকা ছিল না। ভুখা-নাঙ্গা মানুষ হাত পাততো কিন্তু খাবার ছিনিয়ে নিতে পারতো না। দলে দলে লোক একটু খাবারের জন্য হাত পেতে থাকতো কিন্তু পেতো না। আতঙ্কে ধনিরা আরো মজুদ করে ফেলেছিল। বিহার থেকেও হাজার হাজার অভ‚ক্ত মানুষ এসেছিল কলকাতায়। জমিদারগণ এটো ফেললে তা খেতে ঝাপিয়ে পড়তো। মানুষে কুকুরে লড়াই চলতো ডাস্টবিনে। কিন্তু ছিনিয়ে নেয়ার স্পৃহা, নেতা হওয়ার স্পৃহা কিংবা বেঁচে থাকার স্পৃহা তাদের মধ্যে ছিল না। এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষকে সেই দাস মনোবৃত্তিরই মনে হয়।