মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয়বার ওঠছে আইনের খসড়া দুর্নীতি করলে বড় অংকের জরিমানা ক্ষতির দায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের
সোহেল রহমান : দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় নতুন অধ্যায় সংযুক্তি, স্বেচ্ছা ঋণ খেলাপিদের শনাক্ত করা এবং বিধি-বিধান লঙ্ঘনে দন্ডের মাত্রা বাড়িয়ে ১৯৯১ সালে প্রণীত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বড় অংকের জরিমানার মুখে পড়তে হবে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা যাবে ফৌজদারি মামলা। মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
জানা যায়, এর আগে ২০২১ সালের ১৭ মে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনের একটি খসড়া মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। পরে জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর আইনটির কিছু বিষয় আরও সংশোধনের জন্য তা ফেরত পাঠানো হয়। এ প্রেক্ষিতে সংশোধিত আইনটি দ্বিতীয় দফা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় ওঠছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে কর্মরত ব্যাংক কোম্পানিসমূহের কার্যক্রম ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর আওতায় পরিচালিত হয়। ব্যাংকসমূহের মোট সংখ্যা, মোট সম্পদ, আমানত, ঋণ, লিজ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিদ্যমান আইনে সবকিছু কভার করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় দেশের ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা, তদারকি, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, দেশের আর্থিক খাতের সুশাসন ও স্থিতিশীলতার জন্য বিদ্যমান আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।
সূত্রমতে, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো জিনিস রয়েছে, তা হলো- ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই জিনিসটি আগের আইনে অতটা ক্লিয়ার ছিল না। এছাড়া সংশোধিত আইনে ‘দুর্বল ব্যাংক কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার’ সংক্রান্ত নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানির সংকটাপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আছে। ব্যাংক কোম্পানি পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের বিধানও নতুন আইনে আছে। দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াতে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় এসব বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক নির্ধারিত পরিমাণে ও হারে এর তারল্য, সম্পদের গুণগত মান, মূলধন সংরক্ষণ ও আয় অর্জনে ক্রমাগতভাবে, যা দুই বছরের অধিক নয়, ব্যর্থ হলে এবং এ পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়লে এবং অচিরেই ব্যাংকটি আরও সংকটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটিকে ‘দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক চিহ্নিত কোনো ‘দুর্বল’ ব্যাংক নতুন আমানত গ্রহণ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে না। দুর্বল ব্যাংকের পুনর্গঠন বা একত্রিকরণ এবং অধিগ্রহণ কিংবা অবসায়ন কিংবা অন্য কোন উপযুক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি কমিটি গঠন করবে।
খসড়া অনুযায়ী, চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত একটি কর্ম-পরিকল্পনার আওতায় পুনর্গঠনের জন্য ব্যাংকটিকে এক বছরের সময় বেঁধে দিতে পারে। পুনর্গঠনকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নতুন কোনও ব্যাংক-ব্যবসায় নিয়োজিত হতে বা সম্প্রসারণ করতে পারবে না; বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বাৎসরিক ভিত্তিতে তার ঝুঁকি-ভিত্তিক সম্পদ (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঋণ বা অগ্রিম) বৃদ্ধি করতে পারবে না এবং নগদ মুনাফা বন্টন করতে পারবে না।
সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংকটির নিজস্ব পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গঠিত কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে এক একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছেÑ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা; ব্যাংক-কোম্পানির পুনর্গঠন; অন্য কোন ব্যাংক-কোম্পানির সহিত একত্রিকরণ; ব্যাংক কোম্পানি পুনর্গঠনে অন্যান্য যে কোন পদক্ষেপ বা কার্যক্রম গ্রহণ; লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়ন। একই সঙ্গে ব্যাংক-কোম্পানীর সংকটাপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর আওতায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনধিক ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। ক্ষতিকর কার্যকলাপের জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান/ব্যবস্থানা পরিচালক অপসারিত হলে আর্থিক ক্ষতি পূরণে বাধ্য থাকবেন
সংশোধিত আইনে স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের তালিকা করতে প্রতিটি ব্যাংকে দুটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিটি স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের শনাক্ত করবে এবং অপর একটি কমিটি তালিকা চ‚ড়ান্ত করবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সামাজিকভাবে বর্জন করার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য খসড়ায় বলা হয়েছে। এর মধ্যে গাড়ির নিবন্ধন নেয়া, বিমানে উঁচু শ্রেণিতে ভ্রমণ এসব খাতে বাধার সৃষ্টি করতে বলা হয়েছে।
আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, কোনও ব্যাংক ‘ঋণের আসল বা মূল ঋণ মওকুফ করতে পারবে না।’ প্রচলিত নীতিমালার আওতায় ব্যাংক ইচ্ছা করলে কোনো গ্রাহকের মূল ঋণ মওকুফ করতে পারে। ঋণের জামানতের মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যোগ্য বলে বিবেচিত হতে হবে।
অন্যান্যের মধ্যে বিধি বহির্ভূতভাবে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার করা হলে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা ৭ বছরের কারাদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। বিধি লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন ১ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।