‘ব্যবসা’ ক্রমাগত শিখে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া
বিপ্লব পাল
ব্যবসা করা খুব কঠিন কাজ। অধিকাংশ লোকজনের যা বুদ্ধি এবং কাজ করার ক্ষমতা বা শারীরিক মানসিক সক্ষমতাÑ পারবে না। ব্যবসায় সফল হতে গেলে অনেক ব্যাপারে দক্ষ হতে হয়। ম্যান মানেজমেন্ট, ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, প্রোডাক্ট, মার্কেটিং, সেলস। এগুলোর প্রত্যেকটিই পড়াশোনা করা বা গবেষণা করার থেকেও কঠিন কাজ। প্রথম কথা ব্যবসা করা পড়াশোনার থেকে অনেক কঠিন তাই। দুই. সবসময় ব্যবসা যে সফল হবে তা না। গত দশ বছরে আমি অনেক কিছুই চেষ্টা করেছি, তার অধিকাংশই ব্যর্থ। কিছু সফল। কিন্তু কয়েকটি উদ্যোগ সফল হলেই বাকি ব্যর্থতা পুষিয়ে অনেক বেশি কিছুই উঠে আসে। আর ব্যর্থতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। ওই ব্যর্থ হওয়ার মাধ্যমেই আমরা বুঝি কী কাজ করবে, আর কী কাজ করবে না। সুতরাং ব্যবসাও একটি ক্রমাগত শিখে যাওয়ার প্রক্রিয়া। শুধু বই পড়ে লোকে শেখে না। ব্যবসা করতে গিয়েও শেখে-ব্যবসায় ব্যর্থ হলে আরও বেশি শেখে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলছে, আমি স্কুল বা আইআইটিতে যা কিছু শিখেছি, ব্যবসা করতে এসে সেই শিক্ষা সব থেকে বেশি কাজে লেগেছে। চাকরিতে তার ১০ শতাংশও লাগত নাÑএমনকি গবেষণার চাকরিতেই ছিলাম ১২ বছর। পিএইচডির পর, সেখানেও খুব বেশি পড়াশোনা লাগতো না। কারণ অধিকাংশ গবেষণা একটা খুব ন্যারো বা সংকীর্ণ ফিল্ডে হয়। সব ব্যবসাতেই আজকাল বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জ্ঞান লাগে। মার্কেটিং, সেলস, প্রোডাক্ট ডেভেলেপমেন্টÑসবকিছুই আজ অঙ্কের ছকে হয় এবং সেভাবেই ব্যবসা সাজাতে হয়। তারপরে ফেলিউরের মাধ্যমে শিখতেও হয়। স্কুল কলেজে যে শিক্ষাটা চলছে, যাকে আপনারা পড়াশোনা বলছেনÑ তা সম্পূর্ণ ইউজলেস। যদি সরকারি শিক্ষকতা বা সরকারি চাকরি না থাকত, ওই শিক্ষা শেষে, না কেউ চাকরি পেত না, কেউ ব্যবসা করে খেতে পারত। আমি আইআইটি খরগপুরে বলতে গেলে ম্যারাথন পড়াশোনা লাইফ কাটিয়েছি। ৯১-৯৬ ফিজিক্সে ইন্ট্রিগ্রেটেড এমএসসি করে, ১৯৯৬-২০০০ সালে ইলেক্ট্রনিক্স এবং কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে অপটিক্যাল কমিউনিকেশনে পিএইচডি করি। মধ্যেখানে শুধু ছ’মাস, ইতালির একটা কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপে ছিলাম। এতটা ফিরিস্তি এই জন্যে দিচ্ছি, আইআইটির জীবনের অনেক কিছুই ব্যবসার কাজে লেগেছে, যা চাকরি করার সময় কখনো লাগেনি।
[১] আইআইটির যে শিক্ষা সব থেকে বেশি কাজে লেগেছে, সেটা হচ্ছে র্যাগিং। আমাদের ব্যাচ হচ্ছে শেষ ব্যাচ যেখানে আনরেগুলেটেড র্যাগিং হতো। ১৫ দিন। ওইসব দিনগুলোতে মোটে আমরা দু’ঘণ্টা শুতে পারতামÑবাকি প্রায় চার ঘণ্টা দৌড়, খেলা, সংস্কৃতি খিস্তি শোনা এবং দেওয়া অভ্যাস করা লেগেই থাকত। বিজনেস টাফ লোকেদের জন্য। অভিভাবকরা র্যাগিং পছন্দ করে না। আমি প্রকাশ্যে র্যাগিংয়ের সমর্থক। কারণ এর উপকারিতা আমি নিজের জীবনে পেয়েছি। মেন্টাল রেজিলিয়েন্স ছাড়া ব্যবসায় কেউ টিকতেই পারবে না। [২] দ্বিতীয় যেটা কাজে এসেছে আমার দীর্ঘ হোস্টেল লাইফ। প্রথমে নরেন্দ্রপুর, তারপরে খরগপুরে এতসব ট্যালেন্টেড ব্রিলিয়ান্ট ছেলেপুলেদের সঙ্গে থেকে একটা লাভ হচ্ছে, এদের কি দরকার, এরা কীভাবে মুভ করে, কেন করেÑএসব ভাল বুঝি। ম্যান ম্যানেজমেন্টে কাজে আসে। পাশাপাশি সোশ্যালাইজেশন স্কিল ও সেই সময় তৈরি হয়েছিল। আর আমার অনেক আইআইটির বন্ধুর সঙ্গেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক এখনÑনেটোয়ার্কিং তো বিজনেসের একটা পিলার।
[৩] আরেকটা ভালো জিনিস ছিল আমাদের ছাত্র লাইফে। প্রচুর সাহিত্যের চর্চা ছিল। আলটিমেটলি একটা প্রোডাক্ট বেচা বা প্রোজেক্ট বেচা মানে গল্প বেচা। গল্পটা লিখতে হয়। ন্যারেটিভ নামাতে হয়। এটাও ভিত ও তখন তৈরি হয়েছে। [৪] এবার প্রথাগত বিদ্যাচর্চায় আসি। ফিজিক্স এবং ইলেক্ট্রনিক্স- প্রোডাক্ট লাইনে খুব কাজের জিনিস। যদি কেউ শেখে, মানে ল্যাবে শেখে অফকোর্স। আমি প্রায় প্রতিটা সামারে আমাদের নানান রিসার্চ ল্যাবে কাজ করতাম। তখন কেউ ইনার্নশিপে পয়সা দিতে না। থার্ড ইয়ারে সাহা ইন্সটিউটিটে কাজ করার সময় প্রথম ইন্টার্নশিপের পয়সা পাই। সেখানে আমাকে বানাতে দিয়েছিল একটা বিশেষ ডিজাইনের এসি ম্যাগনেট। ওদের ওয়ার্কশপে গিয়ে বসে থাকতে হত ধরনা দিয়ে। সেটা সিপিএমের আমল। কেউ কাজ করত না। সকাল এগারোটা পর্যন্ত আনন্দবাজার পড়তো। অনেক অনুরোধ উপরোধ করে, দু’ঘণ্টার কাজ দুই সপ্তাহে করত। কিন্তু সেটাও একটা অভিজ্ঞতা। ওয়ার্কশপের লোকেদেরকে দিয়ে কাজ করানো লম্বা এক এক্সপেরিয়েন্স। পিএইচডির সময় মূলত সিমুলেশন করতাম। অধিকাংশই অঙ্ক এবং সেইসব অঙ্কগুলোই কম্পিউটারে সিমুলেট করা। পরবর্তীকালের চাকরি জীবনেও সেটাই করতাম। সিমুলেশনের ব্যবসা আমি করি না।
তবে সিমুলেশনের অভিজ্ঞতা আমার ব্যবসার কাজে ভালোই লাগে। বেসিক্যালি ছাত্রজীবনে যা কিছু শিখেছি, তা সব থেকে বেশি কাজে এসেছে ব্যবসার জীবনেই। সুতরাং ব্যবসা করতে পড়াশোনা লাগে নাÑএই মনোভাব সম্পূর্ণ ভুল। যদিও আমি গত দেড় বছর ধরে, ইউনিভার্সিটি অব মেরীল্যান্ডের (বাল্টিমোর) পার্ট টাইম রিসার্চ ফ্যাকাল্টি, তাই এখন হয়তো একাডেমিক্সের টাচে থাকার জন্য ছেলেপুলেদের গাইড করতে একটু বেশি পড়াশোনা করতে হচ্ছেÑরিসার্চ পেপার পড়ার অভ্যেস কিন্তু কোনোকালেই ছাড়িনি। যখন ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি ছিলাম না তখনো সপ্তাতে দুদিন অন্তত ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরী যেতাম। লেটেস্ট পাবলিকেশন, বই তুলতাম পড়ার জন্য। সেই অর্জিত জ্ঞানগুলো, প্রোডাক্ট বানানোর কাজে, মার্কেটিং এর কাজে আসত। পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবসা কীভাবে হবে? আর ব্যবসা মানে, অনেক অনেক টাকা উপার্জন, বিলাস বহুল জীবন, এসব ভুল ধারণা। চাকরির জীবন অনেক আরামের, অনেক নিরাপদের।
বিলাসিতা সেখানেই বেশি। ব্যবসা জাস্ট আমার কাছে অনেক বেশি মিনিংফুল লাইফ বলে মনে হয়। কারণ সত্যিকারের কিছু সৃষ্টি করার চেষ্টা করি। লাইফ তো একটাই। সেখানে জীবনের সদার্থক মিনিং খোঁজাটাই আসল। আমি জীবনে যতো সফল ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিশেছি, কখনোই মনে হয়নিÑতারা বিলাসী জীবনে সন্ধানে টাকার খুঁজছেন। সবাই একটা সফল লেগাসি খুঁজছেন। ঈষৎ সংক্ষেপিত। ফেসবুক থেকে