পুঁজিবাদ, পুঁজিপতি, শ্রমিক এবং দ্ব›দ্ব
আহসান হাবিব
দ্ব›দ্ব হলো দুই বিপরীতের সহাবস্থান। এই মহাবিশে^র বিকাশের প্রধান শর্তই হচ্ছে দ্ব›দ্ব। কিন্তু মানুষ নামের বুদ্ধিমান প্রাণিটি যখন বিকাশের এক পর্যায়ে উদ্ভূত হলো, তখন বিকাশের এই সূত্রটিকে বুঝতে পারেনি। তারা সবকিছুর জন্য অতিপ্রাকৃত এক অদৃশ্য শক্তির কথা কল্পনা করেছিলো। এটা চলে শত শত বছর। বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ প্রথম দ্ব›দ্ব এই প্রপঞ্চটিকে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়। এর পেছনে মানুষকে দিতে হয়েছে প্রচুর মূল্য। কেন না এই অদৃশ্য শক্তি মানে ঈশ^রে বিশ^াসী মানুষ যাদের সংখ্যা এবং ক্ষমতাই ছিলো নিরঙ্কুশ, তারা তাদের বিরুদ্ধ পক্ষের মতামতকে অস্বীকার করতো শুধু তাই নয়, হত্যা করতো। তারা বলতো, এই পৃথিবী অপরিবর্তনীয়, চিরস্থায়ী। যেমন ছিলো তেমনি আছে এবং থাকবে। এটা ঈশ^রের ইচ্ছাধীন। যা কিছু ঘটে তা আগে থেকেই নির্ধারিত। তারা গতিকে অস্বীকার করতো।
এর বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই কেউ কেউ নিজেদের মতামত রাখতো। কিন্তু তাদের মতামত প্রতিষ্ঠা পায়নি, তবে সেগুলো সংগ্রামের অংশ হয়ে সত্য প্রতিষ্ঠায় ভ‚মিকা রেখেছে। সে ইতিহাস লম্বা, এখানে সে আলোচনা করা সম্ভব নয়। মোটাদাগে যদি বলতে হয় তবে প্রথমেই যার নাম করতে হয় তিনি আর কেউ নন, জার্মান দার্শনিক হেগেল। ‘দ্ব›দ্ব হলো দুই বিপরীতের সহাবস্থান’Ñ এই অসাধারণ বাক্যটি তিনি বলেছিলেন। তিনি বস্তুর বিকাশে দ্ব›দ্বকে আবিষ্কার করেছিলেন কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা ছিলো সবকিছুর পেছনে একটি পরম শক্তির হাত থাকাকে বিশ^াস করতেন। ফলে তার এই ডায়ালেক্টিকস ভাববাদীতেই আটকে ছিল। পরে আর এক দার্শনিক ফয়েরবাখ প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করে বললেন বিকাশে কোন অতীন্দ্রিয় শক্তি বলে কিছু নেই, যা কিছু ঘটে তার প্রধান কারণই হচ্ছে দ্ব›দ্ব। তিনি মানবসমাজের বিকাশের ইতিহাসে এই দ্ব›দ্বকে প্রযুক্ত করলেন না। একটি সমাজ কি করে বদলে যায়, সেই সংগ্রামের বিষয়টিকে তিনি সামনে আনলেন না, ফলে তিনি দ্ব›দ্বকে বৈজ্ঞানিকভাবে ধরলেও শুধু ব্যাখ্যা করলেন। ঠিক এই জায়গায় এসে দাঁড়ালেন একজন মানুষ, তিনি আর কেউ নয়, কার্ল মার্ক্স।
তিনি বললেন ‘দার্শনিকেরা এতোদিন শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছে, এখন দরকার বদলানো’। এই বদলানোর কাজ করতে গিয়ে প্রথম যে কাজটি করলেন তা হলো এতোদিন ডায়ালেক্টিকস যে মাথার উপর দাঁড়িয়েছিল, সেটাকে দাঁড় করালেন পায়ের উপর। তিনি দ্ব›দ্বকে বিজ্ঞান ভিত্তি দিলেন এবং শুধু তাই নয়, সামাজিক ইতিহাসকে দ্বা›িদ্বক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে দেখালেন যে মানুষের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রাম আর কিছুই নয়, দুটি পরস্পর বিপরীত চরিত্রের শ্রেণির লড়াই। এই লড়াইয়ের ফলেই পূর্ববর্তী সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে উঠেছে। সামন্ত সমাজ ভেংগে পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে উঠেছে। সামন্ত সমাজের ভেতরেই পুঁজিবাদী সমাজের ভ্রæণ তৈরি হয় এবং তারাই ওই সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করে। এটা অবধারিত, কারণ ততদিনে বিদ্যমান সমাজ থেকে আরও উন্নত সমাজের দাবি বাস্তব হয়ে উঠেছে। এই যে একটা সমাজে দুই বিপরীত ধর্মী শ্রেণির অবস্থান, এটাই ওই সমাজের দ্ব›দ্ব। এই দ্ব›েদ্বর ফলে যে লড়াই, তার অবিশ্যম্ভাবি ফল বিকশিত শ্রেণির জয়।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দ্ব›দ্ব হচ্ছে একদিকে পুঁজিপতি, অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণি। এরা পরস্পর বিপরীতমুখি। একই কারখানায় তাদের অবস্থান কিন্তু তাদের চরিত্র আলাদা। এই ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উতপাদন উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা। ফলে এখান থেকে সৃষ্ট সব উদ্বৃত্ত মূল্য পুঁজিপতিই আত্মসাৎ করে যা তৈরি হয় শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমের ফলে। এটাই দ্ব›দ্ব। এই দ্ব›েদ্বর মিমাংসা একটাই পথে, তা হলো ওই উৎপাদন উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ এবং তাকে সামাজিক মালিকানায় আনা। সামাজিক মালিকানা মানেই পুঁজিপতির ব্যক্তিগত ভোগের জায়গায় সামাজিক ভোগে রূপান্তর করা। এর ফলে শ্রেণির বিলোপ করা এবং একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এটাই সামাজিক ঘটনার বৈজ্ঞানিকতা। শুধু কার্ল মার্ক্স বিকাশের দ্ব›দ্বকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিয়েছেন, তাই নয়, ডারউইন প্রকৃতির সবকিছু বিকাশে বিবর্তন তত্বের অবতারণা করেছেন। ধর্ম যে পৃথিবীকে চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনীয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল, বিবর্তনবাদ তাদের এই বিশ্বাসের বুকে চরম কুঠারাঘাত হানে। কেননা তিনি বলেন দ্ব›েদ্বর ফলে তৈরি হয় নতুন নতুন প্রজাতি এবং তাদের টিকে থাকার মূল শর্তই হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন।
তিনি মানব প্রজাতির পূর্বসূরিকে শনাক্ত করে বললেন, এপ (এক প্রকার বানর জাতীয় প্রাণী) থেকেই বিবর্তনের ফলেই মানব প্রজাতির সৃষ্টি। এভাবে তিনি আগে থেকেই সবকিছু যেমন ছিল তেমনের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করলেন। পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়নবিদ্যাসহ জ্ঞানের সব শাখায় সবকিছুর বিকাশে দ্ব›দ্বই প্রধান শর্ত হিসেবে প্রমাণিত হলো। প্রতিটি ক্ষেত্র আলাদা, তাদের সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত, এই আপ্তবচন ভেঙে পড়লো। কারণ ততদিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে শক্তির অবিনাশী সূত্র এবং তাদের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরের ঘটনা। যান্ত্রিক শক্তি তড়িৎ শক্তিতে, তড়িৎ শক্তি আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। হেগেল বলেছিলেন ‘সত্য একটি প্রক্রিয়া’। এই প্রক্রিয়া আর কিছুই নয়, দুই বিপরীত বস্তুর দ্ব›দ্ব এবং সত্য হচ্ছে তার ফল। যেমন পুঁজিবাদে দুই বিপরীত শ্রেণি হচ্ছে পুঁজিপতি এবং শ্রমিক, তাদের দ্ব›েদ্বর ফল পরবর্তী সমাজব্যবস্থা যার নাম সমাজতন্ত্র। এটাই বিকাশের বৈজ্ঞানিক নিয়ম। এর অন্যথা হওয়ার কোন বিকল্প নাই। লেখক: ঔপন্যাসিক